প্রিলি তো হলো! ফলাফলের আগে কী করবেন?

৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ হবে বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন। এখন থেকে ফল প্রকাশ করা পর্যন্ত প্রায় দুই মাস এবং ফলাফলের পর লিখিত পরীক্ষার জন্য আনুমানিক দুই-তিন মাস সময় পাওয়া যাবে। নতুন প্রার্থীদের জন্য এই সময়টা অল্প। তাই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে এখনই। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ৩৫তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তা রবিউল আলম লুইপা

বিগত বিসিএস প্রিলিমিনারি পাসের আনুমানিক নম্বর বিশ্লেষণ করে অনেকেই পাস নম্বর নিশ্চিত করেছেন, অনেকেই আছেন পাস-ফেলের টানাপড়েনে। প্রিলি পাস লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার যোগ্যতা মাত্র, বিসিএস ক্যাডার নির্ধারণের মূল হাতিয়ার লিখিত পরীক্ষা। প্রিলিমিনারি ফলাফলের পর লিখিত প্রস্তুতি নেওয়ার সময় খুব কম পাওয়া যায়, তাই প্রথমবারের প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করতে হবে এখন থেকেই।
প্রিলিমিনারির ফলপ্রত্যাশীদের আগামী দুই-তিন মাসে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতিতে করণীয়—১. প্রার্থীর সৃজনশীলতা ও স্বকীয়তা মূল্যায়ন করা হয় লিখিত পরীক্ষায় তার উত্তরের মাধ্যমে। এ কথাটি মাথায় রেখেই নিজেকে তৈরি করুন। আর এই পরীক্ষায় যত বেশি নম্বর তুলতে পারবেন, কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার পাওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়বে!
২. পিএসসি প্রদত্ত বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস একনজরে পড়ে নিন। বিগত বছরের বিষয়ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন বারবার পড়ে প্রশ্নকর্তাদের মাইন্ড রিড করার চেষ্টা করুন, কোন অধ্যায় থেকে বারবার ও বেশি প্রশ্ন করা হয়েছে, সেগুলো মাথায় রাখুন।
৩. বাজারের নামকরা একাধিক প্রকাশনীর এক বা দুই সেট গাইড বই থেকে নিজের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করুন। গাইড বই থেকে মূল থিম বোঝার পর বিভিন্ন রেফারেন্স বই থেকে অতিরিক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নোট করুন। দেখা গেল, আপনি যে গাইড বই পড়েছেন, অনেকেই সেই একই গাইড বই পড়েছে। তাই লেখার সঙ্গে বিভিন্ন রেফারেন্স দেওয়ার পাশাপাশি স্বতন্ত্র উপস্থাপন উত্তর মূল্যায়নে আপনাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে।৪. গাইড বই ও রেফারেন্স বইয়ের পাশাপাশি দৈনিক সংবাদপত্র, চলতি বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বার্ষিক প্রতিবেদন, সংবিধান, বিভিন্ন আইন, খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত উক্তি, বাংলাদেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল, জোট ও বিরোধ সংক্রান্ত মানচিত্র, দেশ-বিদেশের প্রতিবেদন ইত্যাদি নোট বইতে (লিখিত সিলেবাসের টপিক ধরে ধরে) টুকে রাখুন। পরীক্ষার এ-সংশ্লিষ্ট কোনো প্রশ্ন পেলেই উত্তরে এসব তথ্য (রেফারেন্সসহ) জুড়ে দিতে পারেন।
৫. লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস বিশাল বড়! প্রথমবারের মতো অংশ নেওয়া লিখিত পরীক্ষার্থীরা বড় সিলেবাস দেখে শুরুতেই ভয় পেয়ে যান! কিন্তু পরিকল্পনা করে শুরু করলে তিন-চার মাসে এই সিলেবাস শেষ করা খুব একটা কঠিন কাজ না। পুরো সিলেবাস ৬০ থেকে ৯০ দিনে (দুই-তিন মাস) ভাগ করে একদিক থেকে পড়া শুরু করে দিন। এর আগে যাঁরা লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এই দুই-তিন মাসে সিলেবাস শেষ করতে পেরেছেন, সুতরাং আপনিও পারবেন!
৬. প্রস্তুতিকালে নিয়মিত (সপ্তাহান্তে হতে পারে) বাসায় বসে বা কোনো কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারেন। তাহলে হাতের লেখায় জড়তা থাকলে কেটে যাবে। অনেকে প্রচুর পড়েন, প্রস্তুতিও ভালো হয়; কিন্তু পরীক্ষার হলে নির্ধারিত সময়ে সব উত্তর লিখে আসতে পারেন না। লিখিত পাঁচ দিনের পরীক্ষায় আপনাকে সব মিলিয়ে ২১ ঘণ্টা লিখতে হবে। তাই দ্রুত লেখার অভ্যাস করাটাও প্রস্তুতির উল্লেখযোগ্য অংশ।
৭. বাংলা বিষয়ে ভালো করে পড়লে ব্যাকরণ ও সাহিত্য অংশে পুরো নম্বর পাওয়া সম্ভব। বিগত কয়েক বছরের প্রশ্ন অ্যানালিসিস করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা নোট করে রাখতে পারেন। আর ভাবসম্প্রসারণ, সারমর্ম, অনুবাদ, কাল্পনিক সংলাপ, পত্রলিখন ও গ্রন্থ সমালোচনা স্কুল-কলেজ জীবনের জ্ঞানের সঙ্গে কিছু অ্যাডভান্সড প্রস্তুতি যোগ করে নিলেই হবে।
৮. বাংলার মতো ইংরেজিতেও গ্রামার ও কম্প্রিহেনশন অংশে পুরো নম্বর পাওয়া সম্ভব। বিগত কয়েক বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষন করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা নোট করে নিতে পারেন। সামারি ও লেটার টু এডিটর একাডেমিক জ্ঞান থেকেই উত্তর করা সম্ভব। ট্রান্সলেশন ও রি-ট্রান্সলেশন নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। এটি বাংলা বিষয়েও কাজে লাগবে। লিখিত পরীক্ষার ৯০০ নম্বরের মধ্যে ৬৫ নম্বরই অনুবাদের জন্য বরাদ্দ থাকে (ইংরেজিতে ৫০ নম্বর এবং বাংলায় ১৫ নম্বর)।
৯. গণিত ও মানসিক দক্ষতা বিষয়ে বীজগণিত অধ্যায়গুলো নিয়মিত এবং বেশি বেশি অনুশীলন করতে হবে। এর জন্য গাইড বইয়ের পাশাপাশি নবম-দশম শ্রেণির সাধারণ ও উচ্চতর গণিত এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিচ্ছিন্ন গণিত বইয়ের সাহায্য নিতে পারেন। পাটিগণিত, পরিমিতি, জ্যামিতি ও মানসিক দক্ষতা অংশগুলো অপেক্ষাকৃত সহজ।
১০. সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে সাধারণ বিজ্ঞান অংশে বিগত প্রশ্ন থেকে পরীক্ষায় বারবার আসা অধ্যায়গুলো শনাক্ত করুন। এর প্রস্তুতির জন্য গাইড বইয়ের পাশাপাশি নবম-দশম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাধারণ বিজ্ঞান বই দেখতে পারেন। কম্পিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তি অংশটি তুলনামূলকভাবে সহজ। এর জন্য গাইড বইয়ের পাশাপাশি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির আইসিটি বই থেকে সহায়তা নিতে পারেন। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস টপিকগুলো থেকে একটু ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন করা হয়। এর প্রস্তুতির জন্য গাইড বইয়ের পাশাপাশি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র বই থেকে সহায়তা নিতে পারেন।
১১. বাংলাদেশ বিষয়াবলি বিষয়ের সংবিধান, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রতিবছর অনেক প্রশ্ন করা হয়। এর পাশাপাশি অন্য অধ্যায়গুলো থেকেও ধারণা নিয়ে যেতে হবে। এই বিষয়ে ভালো নম্বরের জন্য গাইড বই নির্ভরতা কমিয়ে মানচিত্র, চার্ট, গ্রাফ, কোটেশনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নোট প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন সংস্থার অফিশিয়াল ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকা, গবেষণাধর্মী বইয়ের সহযোগিতা নিতে পারেন।
১২. আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি থেকে সেকশন-বি এর গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো চিহ্নিত করে নোট করে পড়ুন। বিগত বিসিএসের প্রশ্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় সব বিসিএসে জাতিসংঘ, মধ্যপ্রাচ্য সংকট,  বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি—এই চারটি বিষয়ের ওপর প্রায়ই প্রশ্ন আসে। এর পাশাপাশি সেকশন-এ এবং সেকশন-সি নিয়েও অনুসন্ধানমূলক প্রস্তুতি থাকতে হবে।
এর আগের বিসিএসেও যাঁরা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, তাঁদের প্রস্তুতি এরই মধ্যে নেওয়া আছে। আগের প্রস্তুতি রিভাইজ দেওয়ার পাশাপাশি লেখাকে তথ্যবহুল ও যুক্তিসংগত করতে রেফারেন্স বই, তথ্য-উপাত্ত-চিত্র, উক্তি-যুক্তি সংযোজন নিয়ে পড়াশোনা করাই আপনার জন্য এখনকার প্রস্তুতি। তাই আপনি প্রিলির ফলের আগ পর্যন্ত লিখিত প্রস্তুতির পাশাপাশি অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতিও সম্ভব হলে এগিয়ে রাখতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বড় নিয়োগ পরীক্ষা আসন্ন।
 
প্রিলিতে পাস নিয়ে কনফিউজড? নিন আংশিক প্রস্তুতি
প্রিলির পাস নিয়ে কনফিউজড? তাই লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করবেন কি না—এ নিয়ে অনেকে দোটানায় আছেন! ৪১তম বিসিএসের প্রিলিতে যদি পাস নাও করেন, সামনে ৪৩তম ও পরবর্তী বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় বসতে হতে পারে। সুতরাং এবারের প্রিলিতে পাস না করলেও লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি বৃথা যাবে না! এ ছাড়া বিসিএস লিখিত প্রস্তুতির ফলে এর বাইরে অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষা, এমনকি ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষায়ও অনেক কিছুই কমন পাবেন। তাই ৪১তম বিসিএস প্রিলির পাস নিয়ে সংশয় থাকলে পুরোপুরি সম্ভব না হলে অন্তত আংশিক প্রস্তুতি নিতে পারেন।
আংশিক প্রস্তুতির জন্য বাংলা বিষয়ের ব্যাকরণ, অনুবাদ ও রচনা; ইংরেজি বিষয়ের অনুবাদ ও রচনা; গণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়ের পাটিগণিত, ত্রিকোণমিতি, সেট, সম্ভাব্যতা ও বিন্যাস-সমাবেশ; সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ের কম্পিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তি; বাংলাদেশ বিষয়াবলি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের সংবিধান, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ; আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট অধ্যায়গুলো পড়ে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারেন। এই টপিকগুলো বিসিএস প্রিলি, ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের লিখিত পরীক্ষায়ও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *