বিভক্ত হেফাজত নানা চাপে কোণঠাসা |

একের পর এক সংকটে পড়ে সময় ভালো যাচ্ছে না হেফাজতে ইসলামের। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে জনস্রোত দেখিয়ে দেশে-বিদেশে আলোড়ন তোলা হেফাজত এমন চাপে পড়েনি আগে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসহ এত নেতা অতীতে কারাবন্দিও হননি। সংগঠনের ভাবমূর্তি বাঁচিয়ে টিকে থাকার সঙ্গে আইনি মোকাবেলা এখন হেফাজতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে সংগঠনটি সাম্প্রতিক সময়ে মাঠে নামে। পরে তাদেরই হরতাল ঘিরে ব্যাপক নাশকতার জেরে নেতাকর্মীর ওপর নেমে আসে শতাধিক মামলার খড়্গ। এর পরই যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ড। সংকটের এখানেই শেষ নয়, প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত হন বাবুনগরীসহ ৪৩ কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা ও বিতর্কের কারণে বিভক্তি এবং পাঁচ কেন্দ্রীয়সহ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের ঘটনায় হেফাজতে বিরাজ করছে এক রকম ‘শীতল’ পরিস্থিতি।

এদিকে গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক নেতা লুকিয়ে রেখেছেন নিজেকে। এ রকম প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় এক নায়েবে আমির অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তুলে স্বেচ্ছায় পদ ছেড়েছেন। ভেতরে ভেতরে নেতৃত্বের বিরোধিতা করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে হেফাজতের আরেকটি অংশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, উগ্রপন্থী কর্মসূচিকে ভুল আখ্যা দিয়ে সংগঠনের একটি পক্ষ বিভিন্ন পর্যায়ে সমঝোতার চেষ্টাও করছে। তবে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ মূল নেতারা মামুনুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং সরকারবিরোধী বেপরোয়া কর্মসূচির নাশকতায় ভুল স্বীকার করার পক্ষে নন। তাঁরা ভাবছেন, এমন পদক্ষেপ নিলে সংগঠনটি জনপ্রিয়তা হারাবে। এমন উভয় সংকটের চাপে হেফাজতের নেতৃত্ব। অন্যদিকে নাশকতা এবং ব্যক্তিগত ঘটনায় নজরদারি করে হেফাজতের কয়েকজন নেতাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক সূত্র। এই প্রক্রিয়ায় আরো কয়েকজন নেতাসহ সংশ্লিষ্টরা হতে পারেন গ্রেপ্তার।

গত ২৫ মার্চ থেকে প্রতিবাদ ও হরতাল কর্মসূচিতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় শতাধিক মামলা হয়েছে। গত ৩ এপ্রিল মামুনুল হক সোনারগাঁর একটি রিসোর্টে নারীসহ অবরুদ্ধের ঘটনার জেরে নাশকতারও কয়েকটি মামলা হয়েছে। আল্লামা শফীর মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম আদালতে তাঁর শ্যালক মো. মঈনউদ্দিনের দায়ের করা মামলায় বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনের নামে গত সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)। হেফাজতের কর্মসূচি নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই মামুনুুলের রিসোর্টকাণ্ড সংগঠনটির ভাবমূর্তি আরো সংকটে ফেলে। সম্প্রতি আলোচিত ‘শিশুবক্তা’ হাফেজ মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানীকে গ্রেপ্তারের পর জানানো হয়, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত রফিকুলও গোপনে বিয়ে করেছেন। শাপলা চত্বরের ঘটনার আট বছর পর হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গত রবিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর গ্রেপ্তার হয়েছেন কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদী, কেন্দ্রীয় কমিটির সহপ্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফউল্লাহ, নারায়ণগঞ্জ জেলা সেক্রেটারি মুফতি বশির উল্লাহসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক নেতা। বিতর্কের জেরে গত মঙ্গলবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেন সংগঠনের নায়েবে আমির ও বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। তিনি বলেন, ‘বর্তমান কমিটির কয়েকজন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংগঠনকে ব্যবহার করছেন।’

কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজী বলেন, ‘গত চার-পাঁচ দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আমাদের দেড় শ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে এসব মামলা আমরা মোকাবেলা করব।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের কয়েকজন নেতা জানান, ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময় চাপে পড়লেও দীর্ঘদিন সংগঠনের নেতারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। তবে গেল বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আমির আল্লামা শফী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর তাঁর শ্যালক বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। ১৫ নভেম্বর শফীর অনুসারীদের বাদ দিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি হওয়ার পর থেকেই প্রথমবারের মতো দেখা দেয় বিভক্তিরেখা। আগের কমিটিতে বিভিন্ন পদে থাকা নেতারা বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও কৌশলগত কারণে তাঁরা পাল্টা কমিটি গঠন করেননি। তবে বর্তমানে বিভিন্ন ঘটনায় সংগঠনের কিছু নেতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় বাদ পড়া নেতাদের অনেকে খুশি। বিতর্কের পরও মামুনুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় কেউ কেউ এখন মুখ খুলছেন।

তবে সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মো. মীর ইদরিস বলেন, ‘হেফাজত ইমেজ সংকটে পড়েনি। বরং অরাজনৈতিক এই সংগঠনের গ্রহণযোগ্যতা দেখে সরকার মানসিক সংকটে পড়েছে। আমাদের নেতাকর্মীরা কোনো অপরাধ করেননি। সে কারণে চাপে থাকার প্রশ্নই আসে না।’

জানতে চাইলে আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নীতি আদর্শের মধ্যে নেই। দুর্বৃত্ত ও দুর্বৃত্তায়নের হাতে চলে গেছে। যাঁরা হেফাজতের ইউনিয়ন কমিটির নেতা হওয়ার যোগ্য না বর্তমানে তাঁদের অনেকেই কেন্দ্রীয় নেতা বনে গেছেন। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ এবং রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণে বর্তমানে হেফাজতে ইসলাম নেতৃত্বহীন, আদর্শহীন ও লক্ষ্যহীন সংগঠনে পরিণত হয়েছে। আমরা কৌশলগত কারণে কমিটি গঠন করিনি। পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি।’


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *