শীতলক্ষ্যায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার হয়েছে গতকাল। সঙ্গে সারি সারি লাশ। নারায়ণগঞ্জের মদনঘাট এলাকায় স্বজনহারাদের আহাজারি। ছবি :
‘দুনিয়াতে আমার আর কিছু নেই। আমার ঘরে বাতি জ্বালানোর মতো কেউ রইল না। আমার সব শেষ হয়ে গেল! কী নিয়ে আমি বাচুম? শেষ হয়ে গেল আমার বংশের সব।’—শ্মশানে স্ত্রীর লাশ পোড়াতে পোড়াতে এভাবেই আহাজারি করছিলেন মুন্সীগঞ্জের হারাধন সাহা (৫০)। শুধু স্ত্রীর মৃত্যুই না, নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবিতে তাঁর দুই সন্তানও নিখোঁজ; গত রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের খোঁজ মেলেনি।
রবিবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে পণ্যবাহী জাহাজ ‘এসকেএল-৩’-এর ধাক্কায় অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় ‘এমএল সাবিত আল হাসান’ নামের লঞ্চটি; যেটি মুন্সীগঞ্জ যাচ্ছিল। এ ঘটনায় গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত ২৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে চারজন। স্বজনদের আহাজারিতে বেদনাবিধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয় শীতলক্ষ্যার দুই পারে। যে জাহাজের ধাক্কায় এই লঞ্চডুবি, সেটিকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আটক করা যায়নি।
ডুবে যাওয়া লঞ্চটি গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উদ্ধার করে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’। তখন এর ভেতর থেকে ২২ জনের লাশ উদ্ধার করেন উদ্ধারকর্মীরা। বিকেলে ও সন্ধ্যায় নদীতে এক শিশু ও এক যুবকের লাশ ভেসে উঠলে তা উদ্ধার করেন নৌ পুলিশের উদ্ধারকারীরা। এর আগে রবিবার রাতে উদ্ধার করা হয় পাঁচ নারীর লাশ।
সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ নৌ পুলিশের ওসি মো. শহীদুল ইসলাম জানান, মোট ২৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সব লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে, যতক্ষণ না নিখোঁজদের পাওয়া যাচ্ছে। যে জাহাজটি ধাক্কা দিয়েছে ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা সেটিকে শনাক্ত করেছি। সেটিকে আটক করতে অভিযান চলছে।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সোমবার সকাল থেকেই শীতলক্ষ্যার উভয় তীরে অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষের ভিড় ছিল। লঞ্চটি নদীর তলদেশ থেকে উদ্ধার করতে দেরি হওয়ায় স্বজনরা কখনো কখনো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তবে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ক্রেনের সাহায্যে লঞ্চটি পানির ওপর তুলে আনার পর স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, বিআইডাব্লিউটিএ, নৌ পুলিশসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়। লঞ্চ থেকে একে একে যখন লাশগুলো উদ্ধার করে তীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বজনরা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা বারি বলেন, ‘লঞ্চডুবিতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই মুন্সীগঞ্জের অধিবাসী। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে আমরা ২৯টি মরদেহ হস্তান্তর করেছি।’ তিনি জানান, গত দুই দিনে স্বজনদের কাছ থেকে ৩৩ জন নিখোঁজের তালিকা পায় জেলা প্রশাসন, যার মধ্যে ২৯ জনের লাশ এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর চর সৈয়দপুর কয়লাঘাট এলাকার নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুসংলগ্ন স্থানে একেএল-৩ নামের একটি কোস্টার জাহাজের ধাক্কায় অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় সাবিত আল হাসান নামের লঞ্চটি। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পাঁচ নারীর লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা। রাতেই ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় পৌঁছলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছিল। পরে গতকাল সকাল থেকে উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে এলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে শুরুতে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়। রবিবার রাত থেকেই আমাদের তিনটি ডুবুরিদল কাজ করছে। এখনো উদ্ধার তৎপরতা চলছে। আজ বিকেল ৪টা পর্যন্ত ২৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।’
স্বজনদের বরাতে জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী মৃত ২৯ ও নিখোঁজ চারজন হলেন মুন্সীগঞ্জ সদরের নুড়াইতলী এলাকার মুখলেছের মেয়ে রুনা আক্তার (২৪), মোল্লাকান্দি চৌদ্দামোড়া এলাকার সমর আলী ব্যাপারীর ছেলে সোলেমান ব্যাপারী (৬০) ও তাঁর স্ত্রী বেবী বেগম (৫৫), মালপাড়া এলাকার হারাধন সাহার স্ত্রী সুনিতা সাহা (৪০) এবং তাঁর দুই ছেলে বিকাশ সাহা (২২) ও অনিক সাহা (১২), উত্তর চর মসুরা এলাকার অলিউল্লাহর স্ত্রী সখিনা (৪৫), একই এলাকার আরিফের স্ত্রী বীথি (১৮) ও তাঁর মেয়ে আরিফা (১), মুন্সীগঞ্জ সদরের প্রীতিময় শর্মার স্ত্রী প্রতিমা শর্মা (৫০), মোল্লাকান্দি চরকিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিন (৯০) ও তাঁর স্ত্রী রেহেনা বেগম (৬৫), সিরাজদিখান তালতলা এলাকার মুছা শেখের ছেলে মো. জাকির (৪৫), উজিরপুরের খায়রুল হাওলাদারের ছেলে হাফিজুর রহমান (২৪) এবং তাঁর স্ত্রী তাহমিনা (২০) ও ছেলে আব্দুল্লাহ (১), দক্ষিণ কেওয়ার দেবেন্দ্র চন্দ্র দাসের ছেলে নারায়ণ দাস (৬৫) ও তাঁর স্ত্রী পার্বতী রানী দাস (৪৫), নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কল্যান্দী স্কুল এলাকার সোলেমানের ছেলে সাইফুল (৪৫), একই এলাকার সোহাগের ছেলে আজমীর (১৫), মুন্সীগঞ্জ সদরের রিকাবিবাজার নূরপুর এলাকার মুশকে আলম মৃধার ছেলে শাহ আলম মৃধা (৫৫), টঙ্গীবাড়ি বেতকা এলাকার মুছা শেখের ছেলে জাকির হোসেন (৪৫), রতন পোদ্দারের স্ত্রী মহারানী (৩৭), ঢাকার শনির আখড়া এলাকার রশিদ হাওলাদারের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৪৫), তাঁর স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৩০) ও মেয়ে মানসুরা (৭), মুন্সীগঞ্জ সদরের দক্ষিণ ইসলামপুরের মো. নুরুল আমিনের ছেলে মো. তানভীর হোসেন হৃদয়, মালপাড়া এলাকার সিরাজের ছেলে রিজভী (২০), নোয়াগাঁও পূর্বপাড়া এলাকার মিঠুনের স্ত্রী ছাউদা আক্তার লতা (১৮), মধ্যকোটগাঁও এলাকার মতিউর রহমান কাজীর ছেলে ইউসুফ কাজী, ঢাকা মিরপুর-১১-এর বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামের ছেলে মো. সোহাগ হাওলাদার।
লঞ্চ ডুবে যাওয়ার ঘটনায় রাতেই পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববিকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি এবং বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকের নির্দেশে চার সদস্যবিশিষ্ট আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যার প্রধান হচ্ছেন নৌ ট্রাফিক পুলিশের পরিচালক রফিকুল ইসলাম।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, লাশ দাফন ও সৎকারের জন্য মানবিক সাহায্য হিসেবে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারকে। উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করা হয়েছে। নৌ চ্যানেল খুলে দেওয়া হয়েছে। যাতে করে নদীতে নৌযান চলাচল করতে পারে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) মো. সালেউদ্দিন বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান শেষ করা হলেও ফায়ার সার্ভিস অভিযান চলমান রেখেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য পাওয়া না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলবে।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার চর সৈয়দপুর এলাকার কয়লাঘাটে আসা মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস বলেন, ‘আমরা এ রকম ঘটনা আর দেখতে চাই না। এটাই যেন শেষ ঘটনা হয়। এভাবে আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। লঞ্চ ও কার্গো মালিকরা ছাড় পেয়ে যান বলেই বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা। এ ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় এনে শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
মুন্সীগঞ্জের হারাধন সাহার স্ত্রী সুনিতা সাহা দুই ছেলে বিকাশ সাহা (২২) ও আকাশ সাহাকে (১২) নিয়ে ঢাকায় জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউট হাসপাতালে গিয়েছিলেন। আকাশকে ডাক্তার দেখিয়ে তাঁরা নারায়ণগঞ্জ লঞ্চঘাট হয়ে মুন্সীগঞ্জ ফিরছিলেন। কিন্তু শীতলক্ষ্যায় লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার পর সুনিতার লাশ উদ্ধার করা হয়, কিন্তু বিকাশ ও আকাশ এখনো নিখোঁজ।
Source: kalerkantho