লকডাউনে কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরছে লাখো মানুষ |

করোনা দুর্যোগে রংপুর অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ ইতোমধ্যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছেন। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত যাদের উপার্জন একেবারেই সীমিত, সাতদিনের লকডাউনে কর্ম না থাকাসহ অর্থ সংকটে ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে ফিরেছেন গ্রামে। এতে ভয়াবহ করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থান না হলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন উন্নয়ন গবেষকরা।

করোনার থাবায় এমনিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছেন গ্রামাঞ্চলের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই, দিন আনে দিন খায়। লকডাউনের কারণে বিভিন্ন বাহনে বেশি ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে যা ছিল তাও ইতোমধ্যে ফুরিয়ে এসেছে। এতে অর্থনৈতিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সমাজের নানা স্তরে। মানুষের মনে এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করছে, ভর করছে এক অজানা শঙ্কা। কর্ম হারানো বিশাল অঙ্কের জনগোষ্ঠি গ্রামে যুক্ত হওয়ায় পড়ছে কাজের আকাল। অভাব-অনটনে পড়ে অনেকেই জীবিকার তাগিদে অসৎ পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

রংপুরের সবচেয়ে অভাবী এলাকা হিসেবে পরিচিত গঙ্গাচড়া। এলাকায় কাজ না থাকায় এখানকার তিস্তার ভাঙনে সর্বশান্ত হওয়া পরিবারের প্রধানরা আয়ের সন্ধানে বছরের বেশিরভাগ সময় থাকতেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সেখানে তারা কৃষি শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করাসহ কেউ রিকশা চালাতেন, কেউবা কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। কিন্তু করোনাকালে সেখানে কারোরই আর কাজ মিলছে না। কাজ-চাকরি হারিয়ে বাধ্য হয়ে তারা ফিরে এসেছেন বেকারত্বের এলাকা নিজ গ্রামে।

তিস্তার চরের সোনা মিয়া ঢাকার মিরপুরে একটি ছোট্ট গার্মেন্টস এ কাজ করতেন। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সৃষ্ট লকডাউনে ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘কয় বছর থাকি ওইখানে চাকরি করি কোনমতে সংসার চলছিল। এ্যালা বাড়িত আসি দুইদিন থাকি বসি আছি, কোন কাম (কাজ) নাই। বউ-ছাওয়া নিয়া খুব কষ্টে আছি।’ গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনয়নের চরগ্রাম জয়রামওঝা। এখানকার ইউপি সদস্য দুলাল মিয়া জানান, এই চরে ৮০০ পরিবারের বাস। জীবিকার তাগিদে ৬০০ পরিবারের প্রধানই বছরের বেশিরভাগ সময় কাজের সন্ধানে ছুটে যান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। লকডাউনে কাজ না থাকায় বর্তমানে তারা অনেকেই বাড়িতে ফিরে এসেছেন। বেকার হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন।

রংপুর মেডিক্যাল মোড়ে গত সোমবার সকালে হাতে পোটলাসহ ফিরছিলেন কয়েকজন নারী। তাদের মধ্যে রয়েছেন তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী এলাকার আয়শা খাতুন (৪২), জুলেখা বেগম ও গঙ্গাচড়ার আলমবিদিতর ইউনিয়নের সয়রাবাড়ি এলাকার নুর বানু। কথা প্রসঙ্গে তারা জানান, ঢাকায় বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। করোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় লকডাউনের কারণে বাড়িওয়ালা তাদের কাজ থেকে বাদ দেওয়ায় নিজ এলাকায় ফিরে যাচ্ছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তারা জানান, ‘বাড়িত তো কিছুই নাই। কাম না করলে হামার পেটোত ভাত যায় না। এ্যালা কী খ্যায়া বাঁচমো আল্লায় জানে।’

উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন, করোনাক্রান্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা রংপুর বিভাগের আট জেলার লক্ষাধিক মানুষ এলাকায় ফিরে এসেছেন। শহর থেকে কর্ম হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসা মানুষদের নতুন করে কর্মসংস্থানের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এতে কর্মহীনদের মাঝে হতাশাসহ বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা।

রংপুরের উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বিশেষ করে কর্ম হারিয়ে পিছিয়ে পড়া রংপুরের মানুষজন এলাকায় ফিরে আসার বিষয়টি হতাশাব্যঞ্জক। কর্মহীন মানুষদের মূল স্রোতধারায় আনতে না পারলে দেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে বড় ক্ষতি হবে। সেজন্য কৃষিনির্ভর এই এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন করে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন তিনি।


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *