‘আমি আশা করেছিলাম ওই ঘটনার সময় প্রশাসনের কর্মকর্তারা যাঁর যাঁর দক্ষতা ও সক্ষমতার প্রমাণ করবেন। কিন্তু তাঁদের কথার সঙ্গে কাজের মিল খুঁজে পাচ্ছি না।’ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. খলিলুর রহমান। হেফাজতের সহিংসতায় ভাঙচুর হওয়া সোনারগাঁ রয়্যাল রিসোর্ট, আওয়ামী লীগের কার্যালয় পরিদর্শনে শেষে শনিবার বিকেলে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, প্রশাসনের যাঁরা যাঁরা ওই ঘটনার সময় যুক্ত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের যোগ্যতার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন কি না এবং ওই দিন তাঁরা কে কী কাজ করেছিলেন, সেটি তদন্ত করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রয়্যাল রিসোর্টের ঘটনার পরের দিন ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) টি এম মোশারফ হোসেনকে পুলিশের খুলনা অঞ্চলে বদলি এবং সোনারগাঁ থানার ওসি রফিকুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার রয়েল রিসোর্টে গত শনিবার হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক নারীসহ অবরুদ্ধ হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন ছিল নির্বিকার। তারা রয়্যাল রিসোর্ট, রিসোর্টে থাকা সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তায় দীর্ঘ প্রায় ৩ ঘণ্টায় নিতে পারেননি সঠিক পদক্ষেপ কিংবা মামুনুল হককে দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে না নেওয়ায় ঘটেছে অনাকাঙ্খিত ঘটনা এমনই দাবি রাজনৈতিক নেতাদের।
জানা যায়, ৩ এপ্রিল শনিবার হেফাজত নেতা মামুনুল হক এক নারীসহ সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্ট নামের একটি রিসোর্টে নিজে গাড়ি চালিয়ে বিকাল ৩টায় ৫০১ নম্বর রোম বুকিং নেন। বুকিং রেজিস্টারে স্ত্রীর নাম লিখেন আমিনা তৈয়্যেবা। বিষয়টি জানা জানি হওয়ায় স্থানীয় এলাকাবাসী ও যুবলীগ ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। খবর পেয়ে সোনারগাঁ থানা পুলিশের একটি টিম স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে নিয়ে রিসোর্টে প্রবেশ করেন।
পরে র্যাব ১১ এএসপি জসিমউদ্দিন, জেলা পুলিশের অরিক্তি পুলিশ সুপার (তদন্ত) টি এম মোশারফ ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) গোলাম মুস্তফা মুন্না ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও দেখা যায়নি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতিকুল ইসলামকে।
মামুনুলকে জেরার সময় ফেসবুক লাইভে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে হেফাজত নেতারা বিভিন্ন মাদরাসা ও মসজিদ থেকে তাদের নেতাকে ছাড়িয়ে নিতে সংগঠিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে সোনারগাঁয়ের অধিকাংশ কওমী মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক, বিএনপি, জামায়েত ও হেফাজত নেতারা সংগঠিত হয়ে বিনা বাঁধায় রয়েল রিসোর্টের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেই ভাঙচুর শুরু করে। ভয়ানক বিপদের কথা আঁচ করতে পেরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্থানীয় সাংবাদিকরা পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে নিজেদের জীবন রক্ষা করেন।
এক পর্যায়ে র্যাব, পুলিশের উপস্থিতিতে তারা মামুনুল হককে ছিনিয়ে নিয়ে যান। পরে রাস্তায় সরকার বিরোধী স্লোগান দিতে দিতে তারা মামুনুল হককে নিয়ে হাবিবপুর ঈদগাঁ মাঠে সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। এদিকে রয়্যাল রিসোর্টে তাণ্ডব চলতে থাকে। পরে মামুনুলের দাবি করা স্ত্রীকে নিয়ে তারা আবার ফিরে যান।
হাবিবপুর ঈদগাঁ মাঠে প্রতিবাদ সভা শেষ করে হেফাজত নেতারা ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে থাকা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সরকার বিরোধী স্লোগান দিয়ে রাস্তায় থাকা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে।
যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নুকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাড়িতে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করে এবং গ্যারেজে থাকা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। নান্নুকে খুঁজতে তার বাড়ির নিচ তলার ভাড়াটিয়াদের ঘরে তল্লাশি চালিয়ে না পেয়ে ভাড়াটিয়াদের ঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। পরে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সোহাগ রনির বাড়িতে হামলা চালায়। হেফাজত সেদিন বিনা বাধায় এ তাণ্ডবলীলা চালায়। পুরো ঘটনায় সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে।
এ ব্যাপারে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী জানান, ইউএনও আতিকুল ইসলাম স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের খবর দিয়ে রয়্যাল রিসোর্টে আসতে বলেন। পরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফেসবুকে অনেকগুলো লাইভ চললেও কোনো ক্যামেরায় তিনি ধরা পড়েননি।
এ ব্যাপারে ইউএনও আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি রয়্যাল রিসোর্টে গিয়ে ভুল করে অন্য একটি কক্ষে চলে গেলে কক্ষটি বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়। সে কক্ষে একাধিক বিদেশিও ছিল। হেফাজতের ছোড়া ইটপাটকেল থেকে বাঁচতে বিদেশিদের নিয়ে আমি দীর্ঘ সময় ফ্লোরে শুয়ে ছিলাম।
এ বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা জানান, তিনি আমাদের ফোন করেছেন সাড়ে ৪টার দিকে আর হেফাজত কর্মীরা আক্রমণ চালিয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। এ দীর্ঘ সময় তিনি কোথায় ছিলেন এ প্রশ্ন গণমাধ্যম কর্মীদের।
মতবিনিময় সভায় বিভাগীয় কমিশনার বলেন, যাঁরা যে জায়গায় চাকরি করছেন, তাঁরা সে জায়গায় উপযুক্ত না হলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কেউ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য তিনি নির্দেশ দেন।
Source: kalerkantho