এসি রুমের সেই লিটন সূর্যের নিচে |

ছিলেন গার্মেন্ট কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপক। গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকার সড়কে দাঁড়িয়ে এখন বিক্রি করেন তরমুজ। ছবি :

চৈত্রের ঝলসানো রোদ্দুর। ঘামে চিকচিক করছে মাস্কবন্দি মুখখানা। ঘামের স্বাদ নোনা, তাঁর জানা। কিন্তু এখন হরহামেশা ঠোঁটে এসে লাগে, ফলে নিজেই টের পান কষ্টের ঘাম কতটা নোনা! ছিল পোশাক কারখানায় বড় পদে চাকরি। বসতেন আয়েশি অফিসে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। সুখটাও ছুঁয়ে দেখেছেন কাছ থেকে। সেসব তাঁর কাছে যেন কষ্টের কবিতা। বর্তমানটা তাঁর যোজন যোজন বিষাদের। এখন ফুটপাতটাই তাঁর ‘অফিস’। তরমুজভরা ভ্যানগাড়ির পেডালে ঘোরে তাঁর জীবিকার চাকা। তবে সেখানে নেই তাপানুকূল যন্ত্র, আছে ‘নিষ্ঠুর’ কষ্টের উন্মাদনা! করোনাযুদ্ধে শরীর না হারলেও স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছেন গাজীপুরের লিটন মিয়া (৪৪)।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে কিশোর বয়সেই তিনি শুরু করেছিলেন জীবিকার সংগ্রাম। পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে সততা, কর্মনিষ্ঠা আর দায়িত্বের প্রতি অবিচল থেকে পাড়ি দিচ্ছিলেন একের পর এক সাফল্যের ধাপ। পদোন্নতি পেয়ে একসময় হয়েছিলেন কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপক (পিএম)। স্বপ্নপূরণ যখন খুব কাছে তখনই করোনা-ঝড়ে লিটনের সব কিছুই এলোমেলো। কারখানার চাকরি হারিয়ে সংসার বাঁচাতে এখন গাজীপুরের জয়দেবপুর শহরের রাস্তায় রাস্তায় তরমুজ বিক্রি করেন তিনি। গাজীপুরের শ্রীপুরের গাজীপুর গ্রামের কৃষক মো. সামসুল হকের ঘরে লিটনের বেড়ে ওঠা।

গতকাল শনিবার দুপুরে জয়দেবপুর শহরের ব্যস্ততম রাজবাড়ি সড়কের জোড়পুকুর কাঁচাবাজারের সামনে দাঁড়িয়ে তরমুজ বিক্রি করার ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় লিটন মিয়ার সঙ্গে। কাঠফাটা রোদে বারবার ঘাম মুছতে মুছতে জানাচ্ছিলেন তাঁর লড়াকু জীবনের বিষণ্ন কথা।

লিটন মিয়া বলেন, ‘বাবা ছিলেন কৃষক। অভাব-অনটন লেগেই থাকত। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে আমি বড়। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করব, সংসারে সুখ ফেরাব।’

১৯৯১ সালে লিটন বাড়ি ছেড়ে জীবিকার খোঁজে পাড়ি জমান রঙের শহর ঢাকায়। বনানীর একটি মেসে উঠে পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে একটি কারখানায় হেল্পার পদে চাকরি নেন। সেই থেকে জীবিকার সংগ্রাম শুরু তাঁর। প্রথমে বেতন ছিল ৩৩০ টাকা। দু-তিন বছরে পদোন্নতি পেয়ে অপারেটর, সুপারভাইজর এবং পরে লাইন চিফ হন। বেতনও বাড়তে থাকে। ২০০৩ সালে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের এক বছর পর খরচ বাঁচাতে ঢাকা থেকে চলে আসেন গাজীপুরে। সুপারভাইজর পদে চাকরি নেন প্যানুইন গার্মেন্টে। তখন গার্মেন্টে বেতন ছিল কম। ওই অল্প বেতনে জীবন চলা হয়ে পড়ে অসম্ভব। তাই ভাগ্য ফেরানোর আশায় তিল তিল করে জমানো টাকায় ২০০৮ সালে পাড়ি জামান সৌদি আরব। কাজ পান একটি রেস্টুরেন্টে, কিন্তু আদম ব্যবসায়ী যে বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পেতেন তার চেয়ে অনেক কম। যা বেতন পেতেন সংসার খরচ ও ছেলের লেখাপড়া পেছনেই শেষ হয়ে যেত। তিন বছর পর দেশে ফিরে যোগ দেন গাজীপুরের কেওয়া এলাকার থ্রিজি গার্মেন্টে।

ছেলে ফাহিম মাহমুদ এসএসসি পাস করে ভর্তি হয় গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে। খরচ বেড়ে যায়। থ্রিজিতে যোগ দেওয়ার সময় ছিলেন কারিগরি ব্যবস্থাপক। বেতন ছিল ২২ হাজার টাকা। চার বছর আগে উৎপাদন ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি পান তিনি। বেতন হয় ৪১ হাজার টাকা। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখেই কাটছিল দিন। কিন্তু গেল বছর করোনার লকডাউনের শুরুতে কারখানায় কয়েক মাস বেতন ছিল বন্ধ। পরবর্তী সময়ে দেওয়া হতো ৪০ শতাংশ বেতন। ওই বেতনে সংসারে শুরু হয় টানাটানি। জমানো টাকা থেকে কোনো রকমে টিকে ছিলেন, কিন্তু গত ৩ জানুয়ারি যখন ছাঁটাইয়ের চিঠি হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় তখন লিটনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলে শ্রম আইন অনুযায়ী তিন মাসের বেতন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এখনো তাঁর ভাগ্যে সেটা জোটেনি।

লিটন মিয়া বলেন, ‘ছেলে গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এবার মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৭৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় সে। মেয়ে গাজীপুর শাহীন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। যখন টাকার এত প্রয়োজন, তখনই চাকরিটা গেল। কিভাবে সংসার চালব, ভেবে অস্থির হয়ে পড়ি, কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’ 

লিটন জানান, একদিন ভ্যানগাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। চেহারা দেখে আর কথা শুনে ভ্যানচালক ছেলেটিকে তাঁর অন্য রকম মনে হলো। কথা বলে জানতে পারেন ছেলেটি বিএ পাস। গার্মেন্টে ভালো চাকরি করতেন, এখন ভ্যান চালান। পরে বাসায় ফিরে লিটন সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা করবেন। ভ্যান কিনে পাড়া-মহল্লায় সবজি বিক্রি করবেন। স্ত্রী ও সন্তানদের না জানিয়ে জমানো টাকা থেকে একটি ভ্যান কেনেন। বাকি টাকা দিয়ে আড়ত থেকে বিভিন্ন ধরনের তরকারি কিনে শহরে এনে বিক্রি শুরু করেন। এখন এক মাস ধরে পটুয়াখালী থেকে তরমুজ এনে বিক্রি করছেন। সেই আয় দিয়ে লিটন এখন কোনো রকমে সংসারটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।

লিটন বলেন, “তরমুজ কিংবা সবজি বিক্রি করি, এটা প্রথম প্রথম পরিবারের কেউ জানত না। শুরুতে এই ঘাম ঝরানো খাটুনি দুঃস্বপ্ন ঠেকলেও এখন বাস্তবতায় ফিরে এসেছি। আগে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে কাজ করতাম, এখন রোদে পুড়ি। এই তো। কিছুদিন আগে ছেলের সহপাঠীরা দেখে ফেলায় স্ত্রী-সন্তান জেনে যায়। লজ্জায় ছেলে সামনে আসে না। পরিবারের সবাই চায় এ কাজ ছেড়ে দিই, কিন্তু সন্তানের লেখাপড়ার কথা ভেবে পারছি না। তবে ছেলের সহপাঠীগুলো খুবই ভালো। ওরা বেশ উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছে। বলেছে, ‘আংকেল, লজ্জার কী আছে, আপনি তো খারাপ কিছু করছেন না। খেটে খাচ্ছেন।’”

লিটন বলেন, ‘এখন আমার একটাই লক্ষ্য, ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার চাকরি খুঁজব। জীবনে কোনো দিন দুর্নীতি করিনি। কাজে ফাঁকি দিইনি। আশা করি, এর প্রতিদান পাব।’

তরমুজ বিক্রির ছবি তুলতে চাইলে মাস্ক দিয়ে মুখ ভালো করে ঢেকে নিলেন লিটন। ছলছল দুই চোখ তাঁর মনের ভাষা জানান দিচ্ছিল এভাবেই—‘করোনা মাস্ক দিয়ে মুখের সম্মান ঢাকতে পারে, কিন্তু জীবন-জীবিকা একবারে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে!’


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *