লক্কড়ঝক্কড় লকডাউনের চক্কর |

গতবার যখন লকডাউন হলো তখন কী করবে-না করবে ভেবে পাচ্ছে না মানুষ। নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন প্রাইমের গ্রাহক বাড়ল হু হু করে। কিন্তু সিনেমা-নাটক আর কত দেখা যায়। পরিচিত লেখক বন্ধুদের অনেকেই লেখালেখির দিকে মন দিল। লেখার আমন্ত্রণও আসতে থাকল কিছু। এড়িয়ে গেলাম যথাসাধ্য, সত্যি বললে লেখার মতো মানসিক অবস্থাও ছিল না, তা ছাড়া মহামারি বা ঘটনার সময় তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো কিছু নিয়ে লেখাটা খণ্ডিত লেখা হয় বলে আমার ধারণা।

তবু অনুরোধ রাখতে ১০০ শব্দের দু-একটা গল্প লিখে ফেললাম। একটা গল্প এ রকম—

‘‘সেলিম সাহেব লকডাউনের আগে বাজারে গিয়ে বিশ বোতল স্যানিটাইজার, পঞ্চাশ পাতা করে নাপা এবং সিভিট, বিশ হালি লেবু, দশ কেজি মাল্টা কিনে ফেললেন। লাইনের পেছনে লোকেরা আজেবাজে কথা বলল, তিনি কান দিলেন না। দুঃসময়ে সব শুনতে নেই। রিকশা ভর্তি করে মহানন্দে ফিরছেন, হঠাৎ পেছন থেকে একটা ভ্যানের ধাক্কায় সব ছিটকে পড়ল। আর কিছু দুষ্টু লোক সেগুলো নিয়ে ছুটে পালাল। সেলিম সাহেব রেগে আগুন হয়ে বললেন, ‘এই সব অমানুষদের কারণেই দেশে মহামারি আসে। মানবিকতা নেই। আরেকজনের কথা একটুও ভাবে না।’’’

এটা গল্প। কিন্তু সত্যি কি এসব ঘটনা ঘটেনি? আজ যখন আবার ‘লকডাউন’ বা ‘নিষেধাজ্ঞা’ বা ‘নানা দফার বিধি-নিষেধ’ দিয়ে মানুষকে আটকানোর চেষ্টা চলছে, তখন গতবারের স্মৃতিগুলো খুব ফিরে আসছে। বিপদ-দুর্ঘটনা মানুষের ভেতরের মানুষটাকে বের করে আনে। সেই ছবিটা দুই রকম হয়। কোনো মানুষ বিপদে প্রচণ্ড মানবিক হয়ে যায়। কেউ কেউ এখানে আরো আত্মকেন্দ্রিক-সুযোগসন্ধানী। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষই বেশি দেখেছি। দেখে দেখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাসও নষ্ট হয়ে গেছে।

পরিচিত একজন একদিন ফেসবুকে কয়েকটি ছবি পাঠাল। একজন মানুষ এলাকার গরিব মানুষদের হাত ধোয়ার সাবান উপহার দিচ্ছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘটনা অত্যন্ত আনন্দের। ভাবলাম, পত্রিকায় ছাপার জন্য পাঠিয়েছেন বোধ হয়।

কিছুক্ষণ পর তাঁর ফোন, ‘ছবিগুলো দেখেছেন?’

‘দেখলাম।’

‘ভাবেন অবস্থা! সে আমাদের এলাকার ছোট পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ও গোটা বিশেক সাবান কিনেছে। তারপর প্রতিদিন দুইটা-তিনটা করে দেয়, আর সারা দিন ফেসবুকে প্রচার করে। লোকজন ভাবছে, মহা জনদরদি; কিন্তু আসলে ঘটনা এই।’

মনটা খারাপ হয়ে গেল। আবার মন ভালো করার ঘটনাও আছে। এলাকার চেনা এক তরুণ একদিন ফোন করে কিছু সাহায্য চাইল। করোনাদুর্গতদের জন্য কিছু করতে চায়। সামান্য কিছু টাকা পাঠালাম একরকম কৌতূহল থেকে। ছেলেটার ভাবমূর্তি খুব ভালো না, উড়ে আর ঘুরে বেড়ায়। সমাজকর্মে কোনো দিন আগ্রহ দেখিনি। তবু ভাবলাম, দেখি মহামারির ছায়া তার মধ্যে বদল আনতে পেরেছে কি না। যা শুনলাম তা অবিশ্বাস্য। সেই ছেলে করোনা রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার কাজ করছে। কয়েকটা গাড়ি ভাড়া করেছে, কেউ ফোন করলেই তার দল ছুটে যায়, রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছায়। সেই সময়ের কথা বলছি, যখন করোনা রোগীকে কেউ ছুঁয়ে দেখত না। কে বলে, মহামারি শুধু অমানুষি আর স্বার্থপরতা দেখায়। নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর খোরশেদ তো লাশ দাফন করে পুরো জাতীয় বীর। ইমাম সাহেবও ভয় পাচ্ছেন জানাজা পড়াতে, তখন কি আমরা তরুণ এসি ল্যান্ডকে দেখিনি নিজেই দাঁড়িয়ে গেছেন ইমামতিতে? কিংবা পুলিশের দল দিন-রাতকে এক করেছে চরম সাহসিকতায়।

দুটো দিকই আছে। কিন্তু সেসব নয়, পুরো অভিজ্ঞতায় আমার কাছে অবাক লেগেছে মানুষের সব কিছুকে নিজের জায়গা থেকে দেখার মানসিকতাকে। যে ঘরে থাকে, সে রাস্তায় যারা বেরোয় তাদের নিয়ে যা-তা বলে। যে রাস্তায় বেরোয়, সে আবার যারা সাবধান করছে তাদের নিন্দা করছে এই বলে যে, ‘ঘরে খাবার আছে বলে বড় বড় কথা বলছেন।’ আমরা কেউ যেন মানতেই চাই না, আমার সমস্যা আর আরেকজনের সমস্যা এক নয়। ঘরে থাকা যেমন দরকার, তেমনি কাউকে কাউকে বেরোতেও হয়। এটা ঠিক যে অনেকেই অকারণে বেরোয়, তুচ্ছ স্বাস্থ্যবিধিটাও মানে না; কিন্তু এই ঠিকের বাইরেও একটা ঠিক আছে। কারো কারো সেটা মানার সুযোগই হয়ে ওঠে না। পরিচিত এক বন্ধু প্রায়ই জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিত এজাতীয় মানুষদের নিয়ে—যারা লকডাউন মানছে না, ওরা শেষ করে দিচ্ছে। হঠাৎ করে সে হাওয়া। কোনো খোঁজ নেই। জানলাম, ওষুধ কেনার প্রয়োজনে বেরিয়েছিল একদিন। গাড়ি না পেয়ে হেঁটেছে এবং রাস্তায় কিছু হেনস্তার শিকারও হয়েছে। এর পর থেকে সে লকডাউনের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে। আবার আরেকজন ছিল লকডাউনের বিরুদ্ধে। ঘরে থেকে করোনা জয় হয় না, সুইডেন কিছু না করেও ক্ষয়ক্ষতিতে অন্য দেশের সমান—এসব দিয়ে জোর সওয়াল করত। তারপর একদিন পরিবারের একজন করোনায় আক্রান্ত হলো। ঘটনাপরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত হলো যে তার যথেচ্ছ ঘোরাঘুরি থেকেই। সে চলে গেল এবার লকডাউনের পক্ষে। এই দুই অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত হয়েছি, মানুষ নিজে বিপদে না পড়লে কোনো কিছুই অনুভব করতে চায় না। সেটা করোনার দুঃসময়ে হোক আর সাধারণ সময়ে।

সেই লকডাউন শেষ হলো একসময়। সব প্রায় স্বাভাবিক। কেউ কেউ সতর্ক করছিল, তবু টিকা এসে যাওয়ায় মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্নের দিনগুলো বোধ হয় গেল। গেল না। আবার এলো। আরো ভয়াল চেহারায়। যেদিন এই লেখা লিখছি (মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল) দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু এবং সর্বোচ্চ শনাক্ত। অথচ কী আশ্চর্য, এ দিনই লক্কড়ঝক্কড় ‘লকডাউন’ আরো শিথিল করে বাস চলাচলের ঘোষণা দেওয়া হলো। ব্যবসায়ীরা যেমন আন্দোলনে নেমেছেন, তাতে তাঁদের দোকান খোলা রাখার দাবি মানা হলো বলে। সরকারকে দোষ দেবেন! তা সে নন্দঘোষ তো আছেই। তাদের সমন্বয়হীনতা-পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। আমরা তুলছিও। কিন্তু বিষয়টাকে বাস্তবতার চোখে দেখলে সরকারের প্রতি মমতাও হবে। গত বছরের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠাই সরকারের জন্য কঠিন হচ্ছে; হাতে টাকার টান পড়েছে বলে খবর। কলকারখানা বন্ধ রাখার তাই সুযোগই নেই। সেটা খোলা রাখলে কিছু গাড়ি চালাতে দিতে হবে। গাড়ি চলতে দিলে বইমেলাওয়ালারা বলে, আমাদেরটা বন্ধ কেন? খোলাওয়ালারা বলে আমরা পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবিধি মানব। তবু যদি সময় নির্দিষ্ট করে বলা হতো, এক সপ্তাহ বা ১০ দিন সব বন্ধ, তাহলে হয়তো হতো। অনির্দিষ্টকাল, অনিশ্চয়তার ওপর ভর করে সব বন্ধ রাখার অবস্থা আসলে নেই।

আর মানুষকেও তো খুব উৎসাহী মনে হচ্ছে না। সবার মধ্যেই মানার চেয়ে ভাঙার প্রবণতা বেশি। কেন? এত মৃত্যু, এত শনাক্তেও ভয় নেই যখন গতবার সামান্য ৭০-৮০ জন শনাক্ত আর ৮-১০ জনের মৃত্যুর সময়ে মানুষ যেভাবে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল, সেখানে এবার সাত হাজারের সময়েও সেই ভয় নেই কেন? খুব সম্ভবত উত্তরটা এ রকম যে তখন ক্ষতির মাত্রাটা ছিল অজানা। হলেই মারা যাব এ রকম ভয় চেপে বসেছিল। এখন, এই এক বছরে দেখা গেছে, মানুষ সুস্থও হচ্ছে। করোনা জয় করে দিব্যি হাজারো মানুষ চলছে-ফিরছে। এর চেয়েও বড় ব্যাপার, গত এক বছরের বাস্তবতা। করোনার দুর্ভোগ আর ক্ষতি আমরা দেখেছি। গৃহকর্মী আর গরিব মানুষের হাহাকারও। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত আর বেসরকারি চাকরিজীবীদেরটা সেভাবে বুঝতে পারিনি। কত লোক যে বেকার হয়ে গেছে। কত ছোট ব্যবসায়ী যে আধপেটা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সব শ্রেণির কথা ভাবতে গিয়ে সরকারও তাল হারায়। লকডাউন দিতে চায়। আবার পারে না।

কাজেই সাবধান থাকুন। স্বাস্থ্যবিধি মানুন। মাস্ক পরুন। আর হ্যাঁ, করোনা তো আমাদের মারছে। আমরা যেন একে অন্যকে না মারি।

গতবার করোনার সময় সতর্কতা হিসেবে একজন তাঁর বুয়া-ড্রাইভারদের বিদায় করে দিলেন। সেই সময়ের বাস্তবতায় সঠিক সাবধানতা। কয়েক মাস পর তিনি আক্রান্ত। হাসপাতালে নেওয়ার গাড়ি নেই। ফোন করে বললেন, ‘একটা উবার ডেকে দাও তো।’

‘কেন? গাড়ি?’

‘ড্রাইভারকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন কোন মুখে ওকে ফোন করি।’

ড্রাইভার পরিচিত বলে তাঁর নম্বর ছিল। ফোন করলাম।

সে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসে তার স্যারকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালে।

এই গল্পটা অনেককে বলেছি। বলি এ জন্য যে আমরা যেন শুধু এক চোখে সব না দেখি।

এটাই বোধ হয় করোনা এবং লকডাউনের শিক্ষা যে একা বাঁচার চেষ্টা করলে বাঁচা যাবে না। সবাইকে নিয়ে বাঁচার কথা ভাবলে এই দুর্দিন জয় করে পৃথিবী বেঁচে থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *