কী কারণে এত মৃত্যু |

দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকেই বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে আসছিলেন, সংক্রমণ ঠেকানো না গেলে এ দফায় মৃত্যুর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে বেড়ে যাবে। এখন যতই দিন যাচ্ছে ততই মৃত্যুরেখা উপড়ে উঠছে। পেছনের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী দুই সপ্তাহে এই সংখ্যা আরো বেশি দেখতে হতে পারে। বিশেষ করে গত দুই সপ্তাহে যে হারে শনাক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১.৫০ শতাংশ বা তার কম হারে মৃত্যু হলেও সামনে কোনো কোনো দিন হয়তো মৃত্যুর সংখ্যা আরো বড় হবে।

তবে সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ নিয়ে স্পষ্টত কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, মানুষের বেপরোয়া আচরণ, স্বাস্থ্যবিধি না মানা, পর্যটন, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নানা সভা-সমাবেশে সমবেত হওয়ার কারণে সংক্রমণ বেড়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, দেশে করোনাভাইরাসের মিউটেশন ও নতুন ভেরিয়েন্টের (ধরন) প্রভাবে সংক্রমণের দ্রুত বিস্তার ঘটেছে এবং মৃত্যুও বেড়ে গেছে।

এই ভেরিয়েন্ট ইস্যুতে আলোচনা যোগ করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) উদ্যোগে করা একটি গবেষণা প্রতিবেদন। গত বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা গত ১৮ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে করোনা রোগীদের প্রায় ৫৭টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ৪৬টি অর্থাৎ প্রায় ৮১ শতাংশের ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার করোনা ভেরিয়েন্ট পেয়েছেন। আগের সপ্তাহে অর্থাৎ ১২ থেকে ১৭ মার্চের মধ্যে ৯৯টি করোনা রোগীর নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ৬৪টি অর্থাৎ ৬৪ শতাংশের বেশি দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্ট পাওয়া যায়। তবে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ৩০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে অবশ্য আফ্রিকার  ভেরিয়েন্ট পাওয়া যায়নি।

এই প্রতিবেদনের পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি এই আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের কারণেই দেশে সংক্রমণ দ্রুত ঊর্ধ্বগতি হয়েছে কিংবা অল্প সময়ের মধ্যে অনেকের মৃত্যু ঘটছে?

আইসিডিডিআরবির গবেষণায় সহায়তাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর কে বলেন, ‘গবেষণাটি হয়েছে আইসিডিডিআরবির ল্যাবে। ফলে এটি বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠী বা যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে তাদের সবাইকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এ ছাড়া এই আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের কারণে মৃত্যু বেশি ও দ্রুত হচ্ছে, তারও এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি।’ এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘কোন টিকা কোন ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর কিংবা কার্যকর নয়, তা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো গবেষণা নেই। আবার কোনো টিকারই শতভাগ সুরক্ষা দেওয়ার মতো নিশ্চয়তাও এখনো পাওয়া যায়নি। বরং এটাই সত্যি যে ভেরিয়েন্ট যেটাই হোক না কেন, এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধির পর টিকাই সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষার উপায়। ক্ষতির তুলনায় যেটার উপকার বেশি সেটা আমাদের পরিহার করা চলবে না।’

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘দেশে আগের তুলনায় সংখ্যার দিক থেকে মৃত্যু বেশি হলেও সংক্রমণ ও শনাক্ত অনুপাতে মৃত্যু বাড়েনি। স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা যত বেশি থাকবে ততই সংক্রমণ কমবে, মৃত্যু কমবে। এ ধরনের মহামারিতে মিউটেশনের মাধ্যমে নিত্যনতুন ভেরিয়েন্ট আসতেই পারে, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা একই।’ তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ কে বলেন, ‘আইসিডিডিআরবির যে তথ্য, সেটাকে গুরুত্ব দিলে মনে হচ্ছে দেশে সংক্রমণ এভাবে বৃদ্ধির জন্য আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের একটি ভূমিকা থাকতেই পারে। তবে এটি আমরা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তাদের নমুনা সংগ্রহ কিভাবে হয়েছে সেটাও আমি পরিষ্কার নই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগেই সন্দেহ করেছিলাম, এত দ্রুত সংক্রমণ বিস্তারে নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট কাজ করতে পারে।’

এই বিষয়ে আইসিডিডিআরবির বক্তব্য জানার চেষ্টা করলে প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ বিভাগের ম্যানেজার এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান কে বলেন, ‘এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবি কোনো অফিশিয়াল বক্তব্য দেবে না বলে আমাকে জানানো হয়েছে।’ তবে প্রতিষ্ঠানটির একটি সূত্র জানায়, তাদের গবেষণার প্রক্রিয়া পুরোপুরি ঠিক আছে। কিন্তু এটি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করায় তারা আপাতত কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চায় না।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার দেওয়া তথ্য অনুসারে গতকাল সকাল থেকে আগের ২৪ ঘণ্টার হিসাবে নতুন শনাক্ত হয়েছে ছয় হাজার ৮৫৪ জন। একই সময়ে সুস্থ হয়েছে তিন হাজার ৩৯১ জন। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত ছয় লাখ ৬৬ হাজার ১৩২ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৩০ জন ও মারা গেছে ৯ হাজার ৫২১ জন। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হার ২০.৬৫ শতাংশ। ওই তথ্য অনুসারে ২৪ ঘণ্টায় মৃত ৭৪ জনের মধ্যে ৪৮ জন পুরুষ ও ২৬ জন নারী। যাঁদের বয়স ২১-৩০ বছরের একজন, ৩১-৪০ বছরের পাঁচজন, ৪১-৫০ বছরের ছয়জন, ৫১-৬০ বছরের ১৬ জন ও ষাটোর্ধ্ব ৪৬ জন। যাঁদের মধ্যে ৪৩ জন ঢাকা বিভাগের, ১৫ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, তিনজন রাজশাহী, সাতজন খুলনা, চারজন বরিশাল ও দুজন সিলেট বিভাগের। এঁদের মধ্যে ৭০ জন হাসপাতালে ও চারজন বাড়িতে মারা গেছেন।


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *