ঋণের জাল ডিঙাতে তিনি জাদুর শহরে |

আবদুল খালেক সব ছেড়ে এখন ঢাকায় নিয়েছেন দারোয়ানের চাকরি। ছবি :

চেয়েছিলেন কষ্টের জীবনটা নতুনভাবে রাঙাতে। সুখ খুঁজতে বুনেছিলেন স্বপ্নও। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে দেখিয়েছিলেন সাহস। গতর খাটা আয় থেকে পাঁচ সদস্যের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিয়ে নিয়ম মেনে পাড়ি দিচ্ছিলেন ঋণের কিস্তির একেকটি ধাপ। কিন্তু মাস তিনেক আগে ঋণের টাকা অর্ধেক শোধ না হতেই হঠাৎ রিকশার ব্যাটারি পুড়ে ছাই। এই করোনা মহামারির মধ্যে কারো কাছেই রিকশা মেরামতের জন্য ৩০ হাজার টাকা ধার পেলেন না। বন্ধ হয়ে গেল রোজগার। কিন্তু এনজিওর কিস্তি তো আর মাফ নেই। একদিকে কিস্তির টাকা, অন্যদিকে সংসারের চাকা। চারদিক থেকে যেন অন্ধকার নেমে এলো। আলো খুঁজতে চলে এলেন জাদুর শহর ঢাকায়।

গল্পটা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের বজরাটেক গ্রামের আবদুল খালেকের। নানা ঘটনাপ্রবাহের পর এখন তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বাড়ির দারোয়ান।

জীবনের ৫৮ পেরোনো আবদুল খালেকের দারোয়ানের চাকরি জুটেছে কেবলই চার দিন। মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের ওই বাসার নিচে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় খালেকের সঙ্গে। সেখানেই উঠে আসে তাঁর জীবিকা-সংগ্রামের কষ্টকথা।

আবদুল খালেক জানান, তাঁর বাবা বেঁচে নেই। তবে ওসগারী গ্রামে তিনি ছিলেন ৩০ বিঘা জমির মালিক। তখন মোটামুটি ভালোই কেটেছে দিন। কিন্তু তাঁর বাবা করেছিলেন তিনটি বিয়ে। সব স্ত্রীরই কয়েকজন করে সন্তান থাকায় একেকজনের ভাগে জোটে সামান্য জমি। কিশোর বয়স থেকেই গৃহস্থদের বাড়িতে কাজ করতেন খালেক। পরে একখণ্ড জমি কিনে নিজে একটি বাড়ি করেন। সেখানেই চার মেয়ে, দুই  ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে বাস করছিলেন। কয়েক বছর আগে গ্রামে গ্রামে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। কখনো কখনো পুরনো জিনিসপত্র (ভাঙ্গারি ব্যবসা) সংগ্রহ করে সেগুলো বিক্রি করতেন।

আবদুল খালেক বলেন, ‘ভাঙ্গারির ব্যবসা ভালোই চলছিল। এই ব্যবসা করেই তিন মেয়েকে বিয়েও দিয়েছি। পরে ভাবলাম, ব্যাটারির রিকশা চালালে আরো বেশি রোজগার হবে। সে জন্য একটি এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাটারি রিকশা কিনেছিলাম। তিন মাস আগে একদিন হঠাৎ রিকশার কী জানি হলো! ব্যাটারিসহ সব তার পুড়ে গেল। ঠিক করতে গেলাম। বলল, ৩০ হাজার টাকা লাগবে। কিন্তু এত টাকা আমি কোথায় পাব? ধার করার চেষ্টা করলাম। করোনার মধ্যে সবারই অবস্থা খারাপ। কারো কাছেই ধার পেলাম না।’

আবদুল খালেক আরো বলেন, ‘একদিকে রিকশা বন্ধ, অন্যদিকে প্রতি সপ্তাহে দিতে হয় এক হাজার ৫০০ টাকা করে কিস্তি। মাসে কিস্তি ছয় হাজার টাকা। বাড়িতে এখন এক মেয়ে, দুই ছেলে ও বউকে নিয়ে থাকি। তাদের খরচ চালাতে হয়। কোনো পথ না দেখে ঢাকায় চলে এলাম মেয়ের বাসায়। ভাবলাম, এত বড় শহরে কিছু না কিছু কাজ পেয়েই যাব। এখানে এসে দেখি কাজ পাওয়া কঠিন। আমার মেয়ের জামাই প্রিন্টিংয়ের কাজ করত। এরই মধ্যে তারও কাজ চলে গেল। বিপদের ওপর বিপদ।’

ঢাকায় কাজ খুঁজতে গিয়ে উল্টো আরো তিন হাজার টাকা গচ্চা যায় খালেকের। সেই ঘটনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই মাস আগে বনশ্রীতে একটি সিকিউরিটি কম্পানিতে গার্ডের কাজ নিতে যাই। তারা তাদের ফি ও ইউনিফর্ম বাবদ তিন হাজার টাকা নেয়। আমাকে কাজ দেয় গাজীপুরের কালিয়াকৈরের এক জঙ্গলের ভেতর। মেইন রাস্তা থেকে প্রায় ৪০ মিনিট লাগে হেঁটে যেতে। নির্জন ওই এলাকার রাত থাকে ভূতুড়ে। দলবেঁধে শেয়াল ডাকে, মশার কামড়সহ নানা উৎপাত সেখানে। কয়েক দিন পর কাজ ছেড়ে দিয়ে আবারও ঢাকায় চলে আসি।’

মোহাম্মদপুরে দারোয়ানের কাজ কিভাবে পেলেন জানতে চাইলে আবদুল খালেক বলেন, ‘মিরপুরে মেয়ের বাসার কাছের একটি বাসার দারোয়ান আমার পরিচিত। সেই বাসার মালিক এই বাসার মালিকের আত্মীয়। আমাদের পরিচিত ওই দারোয়ানের মাধ্যমে এই কাজটা পেয়েছি।’

আবদুল খালেক বলেন, ‘এই কাজ করে যা বেতন পাব তা থেকে আগে এনজিওর কিস্তি শোধ করতে হবে। বাকি যা থাকবে তা দিয়েই চালাতে হবে সংসার।’

এ কথা বলতে বলতেই যেন খালেকের চোখে স্ত্রী-সন্তানের মুখ ভাসে। ৫৮ বছরের বজরাটেক গ্রামের মায়া ভুলে রাজধানীতে নোঙর করা খালেকের দুটি চোখ হঠাৎই জলে ভিজে উঠল। হয়তো কাঁদতেও ভুলে গেছেন রাজধানীর এই নয়া দারোয়ান! বিমর্ষ খালেক কথা শেষ করলেন এভাবেই—‘গরিব মানুষের অনেক অনেক কষ্ট, বাবা। করোনা এসে এই কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।’


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *