রাজধানীতে গণপরিবহন চালু হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বালাই নেই। গতকাল বিমানবন্দর সড়কের চিত্র। ছবি :
তপ্ত দুপুর। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন দেড়টা। ভদ্রলোক পুরো পরিবার নিয়ে টঙ্গী ব্রিজের উত্তর পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন সেই সকাল ৯টা থেকে। তখনো যাওয়ার কোনো গতি করতে পারেননি। একের পর এক মাইক্রোবাস সামনে এলেও তারা যা ভাড়া হাঁকাচ্ছে, তা দিয়ে গন্তব্যে যাওয়া অসম্ভব। বললেন মতিউর রহমান। বাড়ির নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধাসহ মোট ১৫ সদস্য নিয়ে তিনি বসেই আছেন। কয়েক মিনিট পর পর বসা থেকে উঠে সবাই ধুলো ঝাড়ছেন। পরিবারের এক যুবককে পাঠাচ্ছেন মাইক্রোবাস খুঁজতে। যুবকটি বারবার ফিরে এসে হতাশার খবরই দিচ্ছেন। ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পরিবারের সঙ্গে থাকা বৃদ্ধা ও তিন শিশু।
মতিউরের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও। স্থানীয়ভাবে একটি ছোটখাটো ব্যবসা আছে তাঁর। পূর্বনির্ধারিত একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ৪ এপ্রিল ঢাকার পাশের বিরুলিয়ায় এসেছিলেন পরিবার নিয়ে। এসেছিলেন বাসে। ৫ এপ্রিল থেকে বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার যান। পরিবার নিয়ে আটকা পড়েন ঢাকায়ই। বাড়ি ফিরতে না পারায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, ফাঁকা বাড়িও তালাবদ্ধ। শেষমেশ গতকাল বৃহস্পতিবার যাত্রা করেন। সকাল ৯টার দিকে টঙ্গী ব্রিজের কাছে পৌঁছেন। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত পাঁচ মাইক্রোবাসচালকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবাই টঙ্গী ব্রিজ থেকে গফরগাঁও বাজার পর্যন্ত ভাড়া দাবি করেন জনপ্রতি ৯০০ টাকা। সেই হিসাবে ভাড়া আসে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। মতিউর বলেন, ‘এখন কী করব বুঝতে পারছি না, আরো দেরি করলে রাত হয়ে যাবে। আবার এত টাকা দিয়েও যাওয়া অসম্ভব। আমার কাছে টাকা আছে মাত্র ছয় হাজার।’
টঙ্গী ব্রিজের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে আরো কয়েক শ যাত্রী দেখা যায়। তারা কেউ ভালুকা, কেউ কালিয়াকৈর আবার কেউ কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী যাবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিআরটিসি বা অন্য বাসে যাচ্ছে গাজীপুর পর্যন্ত। এরপর অন্য যানবাহন ধরে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করবে তারা।
একই অবস্থা দেখা যায় গাবতলী পেরিয়ে আমিনবাজার ব্রিজের ঢালে। গন্তব্যে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকজন যাত্রী। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন মুসাব্বির নামের এক মধ্যবয়সী লোক। খালাতো ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনি বের হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত দুই হাজার টাকায় একটি মোটরসাইকেল ভাড়া করে যাত্রা করেন তিনি।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে দূরপাল্লার যাত্রীসংখ্যা আগের চেয়ে বেশি দেখা গেছে। দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকায় নানা বিকল্প পথে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে তাদের যেতে হয়েছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি থোড়াই কেয়ার : করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ঘোষিত ১৮ দফা সুপারিশ অনুসারে অর্ধেক যাত্রী বহন এবং ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর শর্ত মেনে গণপরিবহন চলাচল করছিল। লকডাউনের আদলে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ৫ এপ্রিল থেকে সব গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুই দিন পর মহানগরীর মধ্যে গণপরিবহন চালু করা হয়। যাত্রী কম থাকার পরও ভাড়া ৬০ শতাংশ বেশি নেওয়া হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখা যায়। কোনো বাসই জীবাণুনাশক ব্যবহার করছে না, যাত্রী কম হলেও তাদের বসানো হচ্ছে প্রতি আসনে। বাস পরিচালনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বেশির ভাগের মুখে মাস্ক নেই, একই অবস্থা যাত্রীদেরও। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উদাসীন বিআরটিসির বাসগুলো।
রাজধানীতে যাত্রী কম হলেও নগর ছেড়ে বাসগুলো গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের সীমানায় পৌঁছানোর পরই এই চিত্র পাল্টে যায়। এ সময় প্রতি বাসে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যায়। যাত্রী নেওয়া হয় প্রতি আসনে, কোনো কোনো বাসে দাঁড়িয়েও।
গতকাল দুপুর ১টার দিকে কমলাপুর থেকে গাজীপুরমুখী বিআরটিসির একটি বাসে দেখা যায়, টঙ্গী ব্রিজের উত্তর পাশ থেকে যাত্রী তোলা হচ্ছে। দোতলা বাসের ওপর ও নিচতলার সব আসনে যাত্রী। বাসে দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করেও যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। বাসটিতে পা ফেলার মতো জো নেই। বাসচালকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলুন।’
বাসযাত্রী মশিউর রহমান বলেন, ‘ভাই, এ বাসে ভিড় হবেই। কারণ আমি ভালুকা যাব। এ বাসে গাজীপুর গিয়ে নামব। একটু এগিয়ে থাকলাম। গাজীপুর গিয়ে অন্য কোনো যানবাহন ধরে ভালুকা যাব।’ রাজধানীর মিরপুর থেকে নারায়ণগঞ্জগামী হিমাচল পরিবহনেও দেখা যায় যাত্রীর উপচে পড়া ভিড়। বাসটির চালকের কাছে স্বাস্থ্যবিধি কেন মানছেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব বাস খুলে দিলে তো এমন যাত্রী পাব না, তাই কিছু রোজগার করে নিচ্ছি।’
মিরপুর থেকে গুলিস্তান, গাবতলী থেকে গুলিস্তান, গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর থেকে বাড্ডা হয়ে উত্তরাসহ বিআরটিসির সব কটি রুটেই দেখা যায় অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে। কোনো বাসেই জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে না। ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত।
সকাল ১১টার দিকে তুরাগ পরিবহনের একটি বাস গুলিস্তান থেকে উত্তরায় গিয়ে থামে। ওই বাসের প্রতিটি আসন ছাড়াও দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করা হয়। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার বিষয়ে চালক আবুল কালাম ও যাত্রীরা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে। চালক বলেন, ‘কেউ আমাদের স্যানিটাইজার নেয় না।’ যাত্রী সামসুদ্দিন বলেন, ‘দেখুন, ওদের বাসে কোনো স্যানিটাইজার আছে কি না? ওরা ভাড়াও বেশি নিয়েছে আবার আমাদের বাধা না মেনে পথে পথে যাত্রী তুলেছে।’
উত্তরার আব্দুল্লাহপুর এলাকায় স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী পরিবহনের চালক মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রশ্ন করলে তো জবাব দিতে পারব না, কম্পানি মালিকরা জীবাণুনাশক না দিলে আমরা কি নিজের টাকায় কিনে দেব?’ গতকাল রাজধানীর আরো কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কোনো বাসে যাত্রী বেশি, কোনো বাসে কম। তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানার ক্ষেত্রে সব বাসের ছবিই অভিন্ন।
Source: kalerkantho