নুসরাত হত্যার দুই বছর, আসামিদের ফাঁসির রায়ের প্রহর গুণছেন পরিবার |

ফেনীর সোনাগাজীর সেই আলোচিত মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এই উপলক্ষ্যে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সীমিত পরিসরে বাড়িতে কোরআন খতম, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন রাফি। মৃত্যুশয্যায় থেকেও খুনিদের বিচার চেয়েছিলেন রাফি। বিচারও হয়েছে।

২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ১৬ আামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশও দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। আসামিদের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আপিলও করা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারির অজুহাতে আটকে আছে আপিলের শুনানি। এদিকে উচ্চ আদালতেও ফাঁসির আদেশ বহাল চেয়ে আসামিদের ফাঁসির প্রহর গুণছেন তার পরিবার। দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শুক্রবার সকালে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চার সদস্যের পুলিশি পাহারায় রয়েছে রাফির বাড়ি। তার মা শিরিনা আক্তারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আজকে দুটি বছর নির্ঘুম রাত পার করছি। মেয়ের শয়ন কক্ষেই আমি ঘুমাই। মেয়ের মৃত্যু যন্ত্রণার সেই চারটি দিন ছিল আমার কাছে বিভীষিকার। সেই ভয়াল দিনগুলো আমার চোখে ভেসে আসলে আর ঘুমাতে পারি না। এর মাঝে আমার একটি ছেলেকেও বিয়ে করিয়েছি। আজকে আমার মেয়ে বেঁচে থাকলে আরেকজনের গৃহবধূ হতো। কিন্তু রাফির শূন্যতা কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়। আমার পরিবারের সদস্যদের সেই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুকে টেনে ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। আমি শতভাগ আশাবাদী উচ্চ আদালতেও আসামিদের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকবে। আমরা আসামিদের ফাঁসি কার্যকরের প্রহর গুণছি। উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে।

২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে আলিম পরীক্ষার্থী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড। ওই বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার নিজ অফিস কক্ষে ডেকে রাফিকে যৌন হয়রানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেছিলেন নুসরাতের মা শিরিন আখতার। ওই দিনই স্থানীয়দের সহায়তায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। 

এরপর সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য ও মামলা তুলে নিতে তার অনুগতরা নুসরাত রাফি ও তার পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। ৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে গেলে সিরাজের লোকজন নুসরাতকে মাদরাসার সাইক্লোন শেল্টারে ছাদে ডেকে নেয়। মামলা তুলে নিতে চাপ দিলে সে অস্বীকার করে। এসময় হাত-পা বেঁধে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা সরে পড়ে। তার শোর চিৎকারে ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।

বর্বরোচিত এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডটিকে শুরু থেকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চান থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। গণমাধ্যমের দৃঢ় অবস্থান এবং পিবিআইর তদন্তে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসতে থাকে। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ২০২০ সালের ২৮ মে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষির সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্ততর্ক গ্রহণ করা হয়। একই বছরের ২৪ অক্টোবর মামলার অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করেন।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), উপজেলা আওয়ামী লীগ সাবেক সভাপতি ও মাদরাসার গভর্নিং কমিটির তৎকালীন সহ সভাপতি রুহুল আমিন, মাদরাসার শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), নুরউদ্দিন (২৩), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), প্রভাষক আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।

২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে  অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিল। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়েছিল। আপিল অগ্রাধিকারভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। 

বাদী পক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে বেঞ্চ করোনার কারণে বাতিল হয়ে গেছে। এর পর বেঞ্চ গঠন হয়নি। তাই মামলাটির শুনানি হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতি কেটে গেলে অগ্রাধিকারভিত্তিতে শুনানি হবে।

মামলার বাদি নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশী। আমাদের পরিবারের জন্য খুনিরা ও তাদের স্বজনরা মারাত্মক হুমকি হচ্ছে তাদের ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যা ইচ্ছা তাই লেখে যাচ্ছে। আমাদের জন্য খুনি ও তাদের স্বজনদের ব্যবহৃত ফেসবুকই হচ্ছে চরম আতঙ্ক। তিনি আরো বলেন, আমরা এই মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানি না। তবে কিছুদিন পূর্বে আমাদের আইনজীবী শাহাজাহান সাজুর মাধ্যমে জেনেছি করোনা পরিস্থিতির কারণে মামলাটির বেঞ্চ গঠনে বিলম্ব হচ্ছে। 


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *