ব্যর্থতার বৃত্তে ওয়াটার বাস |

রাজধানী ঢাকার চারপাশে নৌপথে যাত্রী পরিবহনে ২০০৪ সালে প্রথম নামানো হয় একটি ওয়াটার ট্যাক্সি। এরপর ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট দুটি নৌযান দিয়ে প্রথমবারের মতো ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডাব্লিউটিসি)। তিন বছরে কোনো সফলতার মুখ না দেখলেও ২০১৩ সালের জুলাই মাসে নামানো হয় আরো চারটি ওয়াটার বাস। নানা অজুহাতে বন্ধ থাকা এই সার্ভিস ধুঁকতে থাকলেও ২০১৫ সালে যুক্ত করা হয় আরো চারটি ওয়াটার বাস। পরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতেও চালু হয় ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস। মাঠ পর্যায়ে কোনো জরিপ না চালিয়ে একের পর এক এসব পদক্ষেপে শুধু ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হয়েছে।

ওয়াটার বাসগুলো বুড়িগঙ্গার বাদামতলী ঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবের নানা বাধায় তা আর সচল থাকেনি। ক্রমে ক্রমে ১০টি ওয়াটার বাসের বেশির ভাগই বর্তমানে অচল। যে কয়েকটি সচল আছে সেগুলোও সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জের মধ্যে বুড়িগঙ্গার এপার-ওপার পাঁচ টাকা ভাড়ায় যাত্রী টানছে।

সূত্র জানায়, বিআইডাব্লিউটিসি শুরু থেকেই এই সার্ভিসের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের যুক্তি ছিল, বিদ্যমান নৌপথ ওয়াটার বাস চলার উপযোগী নয়। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সদরঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত নৌ রুটে চলা ওয়াটার বাস যাত্রীদের উপকারে আসেনি। কথা ছিল বাদামতলী ঘাট থেকে যাত্রা করে খোলামোড়া, সোয়ারীঘাট, বসিলা ও রায়েরবাজারে যাত্রী ওঠানামা করা হবে। যাত্রাপথে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনের ভাড়া হবে ১৫ টাকা। কিন্তু যাত্রী না পাওয়া, অতিরিক্ত তেল খরচ, নদীর পার ভেঙে যাওয়া, নাব্যতা ঠিক না থাকা—এমন সব অজুহাত তুলতে থাকে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে সময়মতো বাস মেলে না, ধীরগতি, পর্যাপ্ত বাস না থাকা, সুবিধাজনক স্থানে নামার সুযোগ না থাকা, অতিরিক্ত ভাড়াসহ নানা সমস্যা উঠে আসে যাত্রীদের অভিযোগে।

এ সম্পর্কে বিআইডাব্লিউটিসির যাত্রীসেবা ইউনিটের উপব্যবস্থাপক শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ কে বলেন, ‘সবকটি ওয়াটার বাস নষ্ট নয়। চারটি মেরামতে আছে। চট্টগ্রামে দুটি বাস চলত। তার মধ্যে একটি মেরামতে আছে। আরেকটি চার বছর ভাড়ায় চলেছে। সেটিও বন্ধ রয়েছে। ওই সব বাস সমুদ্রে চলাচলের জন্য তৈরিও না। তাই ঘন ঘন মেরামত করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘এটি মূলত বৃত্তাকার সার্কুলার রোডের সঙ্গে ছিল। কিন্তু সেগুলো পরিপূর্ণ না হওয়ায় আমরা এগোতে পারিনি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নদীদূষণ রোধ এবং ল্যান্ডিং স্টেশন, ওয়াকওয়ে, বনায়ন, নদীপারের সৌন্দর্যবর্ধন ও নৌঘাট থেকে শহরে চলাচলের যানবাহনের ব্যবস্থা না করায় উদ্যোগটি ভেস্তে গেছে।

গত বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাদামতলী ঘাটে ওয়াটার বাস-৯ ভাসছে। পাশের একটি জাহাজের সঙ্গে নোঙর করা বাসটি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এটি অচল। ৪৫ আসনের ওয়াটার বাসটির ভেতরে কোনো আসনই অবশিষ্ট নেই। পূর্ব দিকের অংশে গিয়ে তুরাগ, ওয়াটার বাস-৩, ১১, ১২ সহ ছয়টি বাস পড়ে থাকতে দেখা যায়। উপস্থিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানালেন, তুরাগ পুরোই অকেজো হয়ে গেছে। একই অবস্থা ৯ নম্বরেরও। ১২ নম্বরও বন্ধ রয়েছে ছয়-সাত মাস। যে মালিক ভাড়ায় নিয়েছিল তারা ছেড়ে দিয়েছে ওয়াটার বাস-১১। বাকিগুলো কেরানীগঞ্জে ডকইয়ার্ডে পড়ে আছে।

সোলায়মান নামের এক কর্মী বলেন, ‘আমি যে বাসটিতে কাজ করতাম সেটি কয়েক মাস ধইরা বন্ধ আছে। তয় বেতন দিয়া দেয়।’ পাশে থাকা অন্য একজন বলে ওঠেন, ‘সরকারি জিনিসের কোনো বেইল নাই। যারা ভাড়ায় নিছিল হেরাও ধরা খাইছে। এখন এপার-ওপারে চালায়। তাও মাঝেমইধ্যে বন্ধ থাকে।’

বিআইডাব্লিউটিসির জিএম (কমার্স) এস এম আশিকুজ্জামান কে বলেন, ‘সার্ভিসটি যাত্রীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। আসলে যাত্রী না পাওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বলতে পারেন। বাবুবাজার ব্রিজের নিচ থেকে পাঁচ মিনিট পর পর বাস ছাড়ে। ওয়াটার বাসের আগেই তারা চলে যায়। তা ছাড়া যেখানে মন চায় নামিয়ে দিতে পারে। আমরা নির্দিষ্ট ঘাট পন্টুন ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করতে পারি না। এখন জাহাজগুলো (ওয়াটার বাস) অন্যভাবে ব্যবহার করা যায় কি না, তা ভাবা হচ্ছে।’

বিআইডাব্লিউটিসি সূত্র জানায়, এটি সম্পূর্ণই সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল। মন্ত্রণালয় থেকে এই সিদ্ধান্ত আসার পর কর্তৃপক্ষ বারবার এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেও চালাতে হবে জানিয়ে এটি চাপিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সফলতা-ব্যর্থতা সবার জানা।

বিআইডাব্লিউটিসির যাত্রী ও প্রশাসন জিএম (কমার্স) শেখ মু. নাসিম বলেন, ‘আমাদের মোট ১০টি বাস। এর মধ্যে দুটি চট্টগ্রামে। কোনোটিই পুরোপুরি নষ্ট হয়নি। সার্ভে করানোর জন্য কিছু ডকইয়ার্ডে আছে। বাকিগুলো আস্তে আস্তে যাবে। ঠিক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মূলত বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ দুর্ঘটনার পর বাদামতলী থেকে গাবতলী রুটে ওয়াটার বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।’


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *