আবার ফিরে আসবে আনন্দহিল্লোল |

অনাদিকালের প্রাকৃতিক পরিক্রমের রহস্য উদঘাটিত হয়নি। বৈশাখের উপস্থিতির দিন-ক্ষণ-ইতিহাসে অজ্ঞাত। তবে মাসটির সাড়ম্বর আগমন মানুষকে জানিয়ে দেয় তার ভৈরব আচরণের স্বরূপ। মানুষ স্বভাবতই শক্তিমানকে সমীহ করে। সাধারণত ভয়ে, কখনো শ্রদ্ধায়। কে জানে বৈশাখের প্রলয়ংকরী রূপ দেখে ইতিহাসের কোন প্রদোষকালে চৈত্রসংক্রান্তিতে আবাহন করা হয়েছিল বৈশাখকে। এটা প্রাচীন হলেও আজকের বর্ষবরণ বা পহেলা বৈশাখের আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় খুব পুরনো নয়।

দেশভাগের আগে আমরা পহেলা বৈশাখে দেখেছি, প্রতিবেশী সনাতন সম্প্রদায়ের প্রতিটি বাড়িতে শুচি-শুভ্র আলপনার শিল্পকর্ম, আর ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানের সামনে আমপাতার ঝালর। মনে হতো যেন ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে।’

শৈশব-কৈশোর সন্ধিক্ষণের খেলার সাথি জগদীশ-শক্তিপদ সঙ্গে থাকত। সর্বনাশা দেশভাগে তারা কোথায় হারিয়ে গেল! পহেলা বৈশাখে তাদের স্মৃতি মনকে উদাস করে তোলে। ১৯৪৭ সালের পর পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনেকটা ম্রিয়মাণ হতে হতে প্রায় থমকে দাঁড়াবার উপক্রম হয়। বলতে গেলে গত শতকের ষাটের দশক থেকে পূর্ব বাংলার মানুষ নববর্ষ উদযাপনের উৎসবমুখর আনন্দের সাক্ষাৎ পেতে শুরু করে নতুন অবয়বে। ধর্মের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সর্বজনীনতায় রূপ নিতে থাকে।

চৈত্রসংক্রান্তির অনুষঙ্গী পহেলা বৈশাখে মেলা বসত। তা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নববর্ষ উদযাপন নাগরিক পর্যায়ে উন্নীত করার কাজে ব্যাপৃত হন রাজনারায়ণ বসু। তিনি ওই সময়ে বিদ্যাসাগরের পুণ্য জন্মজেলা মেদিনীপুর সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। উল্লেখ্য, তিনি ঠাকুর পরিবারের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ পান। রবীন্দ্রনাথ ভুবনডাঙ্গার ঊষরপরিবেশে ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াবার’ যজ্ঞে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতেন। যেটি পঁচিশে বৈশাখের আবহে পালিত হতো। লেখা বাহুল্য, এটি তাঁর জন্ম মাসের সূচনা। ধীরে ধীরে তা নাগরিক জীবনকে আন্দোলিত করে এবং পুণ্যাহ আর হালখাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আগেই বলেছি, সাতচল্লিশে দেশভাগের পর বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতায় ভাটা পড়ে। এর পেছনে ছিল কূপমণ্ডূকতা। ইতিহাস বলছে, আরব ভূখণ্ডে বহু বছর আগে থেকে নববর্ষ উদযাপনের রেওয়াজ ছিল। এখনো ইরানের সেরা উৎসব ‘নওরোজ’ অর্থাৎ নতুন দিন বা নববর্ষ। ইতিহাসের সেই দুর্গম পথে পদচারণ না করে আমাদের দেশের দৃশ্যমান ঘটনাপ্রবাহে একটু দৃষ্টি ফেরাই।

১৯৬১ সাল শত বাধাবিপত্তির মাঝে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এর মূলে ছিল পহেলা বৈশাখের আনন্দ-উৎসব নতুন করে উপভোগের প্রচেষ্টা। সন্জীদা খাতুন ওয়াহিদুল হক সে প্রচেষ্টায় ছিলেন অগ্রণী। তাঁদের শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছিলেন ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. খান সরওয়ার মুরশিদ, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ, ডা. সারোয়ার আলী (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ। সে বছর রমনার বটমূলে নবারুণের সঙ্গে নববর্ষের আনন্দ-উৎসব উদযাপিত হলো। সে জীবনমুখী ধারা আজও বহমান এবং দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে গেছে। কারণ এ যে অসাম্প্রদায়িক কাঠামোর চরিত্র নিয়ে বিদ্যমান!

একদা কিছু কূপমণ্ডূক ব্যক্তি পহেলা বৈশাখ উদযাপন থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে থাকতে ইন্ধন জুগিয়েছে। তবে প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগে আমরা বাধাগ্রস্ত হইনি তা নয়। যেমন—কভিড-১৯, অর্থাৎ ২০২০-এর করোনার বিস্তার আমাদের মিলনমেলার আনন্দ-উৎসবকে বিষাদময় করে দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, আঁধার অবশ্যই কেটে যাবে। অচিরেই জ্যোত্স্নাপ্লাবিত হবে সমগ্র দেশ, গোটা বিশ্ব।

কভিড-১৯ প্রকৃতির আক্রোশ। তবে মানবসৃষ্ট দুর্বৃত্তদের থাবায় ১৯৭১ সালে পহেলা বৈশাখের দেখা পাইনি আমরা। তখন চারপাশেই থাকত জীবন্ত সংহারক। মনে আছে নোয়াখালী থেকে প্রায় হেঁটে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঘরে ফেরার সময় ফরিদগঞ্জের চরের ওপর দিয়ে নীলকমলের ঘাট পৌঁছাতে প্রখর রোদে পোড়ার অভিজ্ঞতার কথা। ডিঙি নৌকাযোগে মেঘনা পাড়ি দিয়ে মাদারীপুরের টেকেরহাট আসতে চৈত্র শেষের ঝড়ের কবলে পড়লাম। তীরে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড়ের তাণ্ডব কমে এলো। মেঘে ঢাকা সন্ধ্যার আঁধার ঘনীভূত হলো। এর মধ্যেই হাঁটতে শুরু করলাম। কখনো ক্ষণপ্রভার আলোয় আবার মেঘ সরে গেলে শুক্লপক্ষের ক্ষীণ চাঁদের আলো সঙ্গী করে। নানা দৈবদুর্বিপাকের ভেতর দিয়ে ঘরে ফিরতে গিয়ে চোখে পড়ল শ্মশানের মতো পরিবেশ। নববর্ষ উদযাপনের ভাবনা উধাও হয়ে গেল। লেখা বাহুল্য, ওই সময়ে আমি নোয়াখালী সরকারি কলেজের সদ্য নিয়োজিত অর্বাচীন শিক্ষক। নোয়াখালী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এসে মনে হলো তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় পড়েছি। পহেলা বৈশাখ বলে কোনো অনুষ্ঠান বাংলার মাঠ-ঘাট মুখর করত, তা যেন কল্পলোকের নয় বাস্তব বিভীষিকাময় হয়ে গেল।

১৪২৭ বঙ্গাব্দে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়নি। এর পেছনে কোনো মতবাদ এসে বাদ সাধেনি। করোনা দেশময় ভীতিবিহ্বলতার সৃষ্টি করে বাংলাদেশের মানুষের একটি দিনের আনন্দ-উদ্বেলতা কেড়ে নিয়ে ‘বিশ্বময় বিষাদ কুয়াশা’ ছড়িয়ে দিয়েছে।

একুশে ফেব্রুয়ারির একটি লেখায় বলেছিলাম, দুই হাজার কুড়ির করোনাকে তুড়ি মেরে আমরা আমাদের অস্তিত্বের দিবস উদযাপন করব। করেছি। শোকের আবহে প্রাপ্তির প্রত্যাশার পথরেখা অবলোকনের ভাবনা প্রকাশ করতে। পহেলা বৈশাখ দিনটি নিছক আনন্দের। অথচ করোনা যায় যায় করে লোভাতুর দৃষ্টি হানছে। ব্যক্তির পরশ থেকে দূরে থেকে, এরই মধ্যে, মিলনের সেতু তৈরি করতে হবে আমাদের। লেখা বাহুল্য, উৎসব প্রাণ পায় মিলনের আনন্দে। উৎসব আনন্দের সম্পূরক। একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব অকল্পনীয়। উৎসব বলতেই যেন ‘নব-আনন্দে’ জেগে ওঠার কল-কল্লোলের উঁকি দেওয়া। কভিড-১৯-কে মারি, অতিমারি, মহামারি—যে নামেই অভিহিত করি না কেন, একসময় শক্তিহীন হয়ে পড়বে। প্রবল ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন নতুন অবয়বে ধরা দেয়, তেমনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমরা করোনামুক্ত হব। আবার ফিরে আসবে আনন্দহিল্লোল। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা গেয়ে উঠব :

‘বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন্ অতলের বাণী

এমন কোথায় খুঁজে পেলে।

তপ্ত ভালের দীপ্তি ঢাকি মন্থর মেঘখানি

এল গভীর ছায়া ফেলে…

হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এসে আশার ভাষা উঠলো বেজে,

দিলে তরুণ শ্যামল রূপে করুণ সুধা ঢেলে
 

 

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *