হবিগঞ্জবাসীর খোয়াই নদী প্রকল্পে স্বপ্নভঙ্গ

হবিগঞ্জ জেলার খোয়াই নদী ও পুরাতন খোয়াই নদী নিয়ে প্রস্তাবিত ২ হাজার কোটি টাকার মেঘা প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে পুরাতন খোয়াই নদীর অংশ। এতে করে হতাশা দেখা দিয়েছে হবিগঞ্জবাসীর মাঝে। হবিগঞ্জবাসীর বহুদিনের স্বপ্ন পুরাতন খোয়াই নদীকে দখলমুক্ত করে নান্দনিক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। গত বছরের শেষ দিকে ‘হবিগঞ্জ জেলার  খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এই অংশটি বাদ দেওয়া হয়। 
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, এক হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হবিগঞ্জ জেলার খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন’ প্রকল্পটি প্রস্তাব করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রক্রিয়াকরণ শেষে অনুমোদন পেলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে পুরাতন খোয়াই নদীর ২ দশমিক ৩১ কিলোমিটার খনন ও সংরক্ষণ বাবদ ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, পাঁচটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য ২৪ কোটি টাকা, একটি পাম্প হাউজ নির্মাণে ১৮ কোটি টাকা, সাড়ে চার কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজের জন্য ১৫ কোটি টাকার প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া  প্রকল্পে চার দশমিক ৬৩ কিলোমিটার ড্রেন, ওয়াক ওয়ে ও ফেন্সিং নির্মাণে সাড়ে ২৭ কোটি টাকা, ৫০টি কমিউনিটি গ্রোথ সেন্টার ও রিক্রিয়েশন এরিয়া নির্মাণে ৩৯ কোটি টাকার প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে এবং সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনযুগ পর শুরু হয়েছিল হবিগঞ্জের পুরাতন খোয়াই নদীর উচ্ছেদে কার্যক্রম। দখল করে রেখেছেন এমন ৬০০ পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলেও এক বছর যাবৎ উচ্ছেদ কার্যত বন্ধ থাকে। পাশাপাশি যে সকল এলাকা উচ্ছেদ হয়েছিল সেগুলোর অনেক যায়গা পুনরায় দখল হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩ যুগ আগে নদী শাসনের মাধ্যমে খোয়াই নদীর গতিপথ পরিবর্তন করায় শহরের ভেতরের ৫ কিলোমিটার অংশ পুরাতন নদীতে পরিণত হয়। মূলত এরপর থেকেই সেখানে নজর পরে প্রভাবশালীদের। অব্যহত দখলের ফলে দুই শ ফুট প্রশস্ত নদীটি এখন নালায় পরিণত হয়েছে। আর এসব দখলদারকের তালিকায় রয়েছেন রাজনীতিবিদসহ সুশীল সমাজের ব্যক্তিরাও। এমনকি সরকারিভাবেও নদী ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে জেলা পরিষদ ভবন, মেজর জেনারেল এম এ রব স্মৃতি পাঠাগার, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু বারবার উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হলেও কিছুই দৃশ্যমান হয়নি। বিভিন্ন অপ-শক্তির কারণে বারবারই স্থগিত হয়েছে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৬-৭৭ সালে শহর রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ‘মাছুলিয়া-রামপুর’ প্রকল্পে প্রায় ৩ কিলোমিটার এবং ’৭৮-’৮৯ সালে ‘রামপুর-গরুরবাজার’ প্রকল্প গৃহীত হয়। দুই দফায় ৫ কিলোমিটার ‘লুপ কাটিং’য়ের (আঁকা-বাঁকা সোজাকরণ) মাধ্যমে খোয়াই’র গতি পরিবর্তন করে নদীটিকে শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করে দেওয়ার ফলে শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা খোয়াই শান্ত হয়ে থেকে যায়। এটির নাম হয়ে যায় ‘পুরাতন খোয়াই নদী’। ‘লুপ কাটিং’য়ের আগে ‘পুরাতন খোয়াই নদী’র প্রস্থ ছিল গড়ে ২’শ ৫০ থেকে ৩শ ফুট ও গভীরতা ছিল ২৫ থেকে ৪০ ফুট। নদী শাসনের পর পেরিয়ে গেছে ৪ দশক। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে পুরাতন খোয়াই নদীর অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সাধারণত অরক্ষিত জলাভূমির ক্ষেত্রে যা হয়, পুরাতন খোয়াই নদীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ভূমিখেকোদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে, বিভিন্ন অংশ দখল হয়েছে, পরিকল্পিত-অপরিকল্পিতভাবে ভরাটের শিকার হয়েছে, দূষণের শিকার হয়েছে পুরাতন খোয়াই। সব মিলিয়ে নদী সংশ্লিষ্ট হবিগঞ্জের মানুষের জন্য ব্যাপক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নদীটি। বর্তমানে পুরাতন খোয়াই নদী হবিগঞ্জ শহরের সর্ববৃহৎ ডাস্টবিনে রূপ নিয়েছে। নদীর আশপাশের বাসাবাড়ির পয়ঃনিষ্কাশন, ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে। এই ময়লা-আবর্জনা ফেলার মধ্য দিয়ে দখলি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে।
শহরের মাহমুদাবাদ এলাকা থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত নদীটির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে দখলের কারণে। এরপর আধুনিক সদর হাসপাতালের কাছ থেকে দক্ষিণ শ্যামলীর মুখ পর্যন্ত নদীটির অস্তিত্ব কোনোরকম টিকে আছে। তবে উভয় পাশেই দখল প্রক্রিয়া চলমান। পুরান মুন্সেফীর পেছন থেকে উত্তর শ্যামলী পর্যন্ত আরেকটি অংশে নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেটিও উভয় দিক থেকে দখলের মাধ্যমে সংকুচিত করা হয়েছে। বিশেষ করে পুরান মুন্সেফী ও মুসলিম কোয়ার্টারের পেছনে যত বাসা-বাড়ি রয়েছে তাদের প্রায় সকলেই ধীরে ধীরে নদীটির উপরে উঠে আসছেন। এ ছাড়া কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের সুবিধামত নদীকে ভরাট করে নিজেরদের আয়ত্বে নিয়েছেন। হরিপুর-নাতিরাবাদ অংশে নদীটির অস্তিত্ব একটি মজে যাওয়া খালের মতো। পুরাতন নদীটির শেষ অংশ অর্থাৎ খোয়াই মুখ থেকে বগলা বাজারের মাছ বাজার পর্যন্ত নদীটির বলতে গেলে শুকিয়ে মজে গেছে। এই অংশটিও ক্রমেই দখল হয়ে যাচ্ছে। হবিগঞ্জ শহরের বৃষ্টির পানির প্রধান আধার পুরাতন খোয়াই নদীর অধিকাংশ দখল/ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ফলে পুরাতন খোয়াই নদী নিয়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পে নতুন স্বপ্ন দেখছিলেন হবিগঞ্জবাসী। এখন সেই স্বপ্নভঙ্গের হতাশা বিরাজ করছে সবার মাঝে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, পুরাতন খোয়াই নদী দখলমুক্ত করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন করে আসছি। হবিগঞ্জ শহরকে বাচানোর জন্যই এই নদী উদ্ধার প্রয়োজন। জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে রহস্যজনক কারণে তা বন্ধ রয়েছে। পুরাতন খোয়াই নদী নিয়ে গৃহিত প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা হলে সেটিকে আর রক্ষা করা যাবে না।
বাপার আজীবন সদস্য ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, পুরাতন খোয়াই নদী দখলমুক্ত করলেই হবে না। এটিকে নিয়ে প্রস্তাবিত নান্দনিক প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে হবে। হবিগঞ্জ শহরকে বাচাতে এই প্রকল্পের বিকল্প নেই।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানেওয়াজ তালুকদার বলেন, সরকার পুরাতন খোয়াই নদীর অংশটি বাদ দিয়েছে কারণ এটি পৌরসভার কনসার্ন। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের প্রকল্প করার পর পৌরসভাগুলো হ্যান্ডওভার না নেয়ায় জটিলতা দেখা দেয়। পৌরসভাগুলো জানায় এ ধরনের প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের বাজেট ও লোকবলের অভাব রয়েছে।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান জানান, মূল প্রকল্পে যাতে জেলা পুরাতন খোয়াই নদীর বাদ দেয়া অংশ পুনর্বিবেচনা করা হয় তার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। রবিবার দুপুরে এ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে মিটিং এর আয়োজন করা হয়েছে। পৌরসভার মেয়র শপথ নিলে তাদের সাথেও বসা হবে। যেহেতু হবিগঞ্জবাসী এই প্রকল্প চায় তাই আমাদের জোরালো প্রচেষ্টা থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *