সংক্রমণ নিয়ে উৎকণ্ঠা সতর্ক না হলেই বিপদ

করোনাভাইরাসের দ্রুত এমন ঊর্ধ্বগতিতে উদ্বেগও বাড়ছে সাধারণ মানুষ থেকে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। তথ্য-উপাত্তে জানা যাচ্ছে, এ দফায় যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের ৯৮-৯৯ শতাংশই নতুন, আগে যারা আক্রান্ত হয়নি। এর বাইরে আনুমানিক মাত্র ১-২ শতাংশের মতো দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছে, যারা গত বছরও আক্রান্ত হয়েছিল।
সাত মাস পর দেশে এক দিনে করোনাভাইরাস শনাক্ত দুই হাজার ৮০০ ছাড়িয়েছে। আবার দুই মাস ২৪ দিন পর এক দিনে মৃত্যু উঠেছে ৩০ জনে। গতকাল সোমবার সকাল ৮টা থেকে আগের ২৪ ঘণ্টার এই হিসাব দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর দেশে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষাও হয়েছে এই ২৪ ঘণ্টায়।
যারা নতুন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে আগের মতোই ষাটোর্ধ্বদের নানা ধরনের জটিলতা বেশি এবং যারা মারা যাচ্ছে তাদের মধ্যে ৭৫-৮০ শতাংশই ষাটোর্ধ্ব বয়সের। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হচ্ছে ৫১-৬০ বছর বয়সের। অর্থাৎ আগের মতোই এ দফায়ও অপেক্ষাকৃত কম বয়সের বা ৫০ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যু কম। ফলে বিশেষজ্ঞরা আগের মতো বয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রতি বেশি সতর্কতা অবলম্বনের ওপর জোর দিয়েছেন। বয়স্করা ঘর থেকে বের না হয়েও বা কম বের হয়েও আক্রান্ত হওয়ার পেছনে পরিবারের অন্যদের অসতর্ক চলাফেরাকে দায়ী করা হচ্ছে; যারা নিজেরাই বাইরে থেকে করোনাভাইরাস বহন করে ঘরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বয়স্ক মানুষটিকে বিপদের মুখে ফেলছে।
এ ছাড়া এখন যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তাদের বড় একটি অংশেরই সাম্প্রতিক সময়ে টিকা নেওয়ার পর অসতর্কভাবে বিভিন্ন সামাজিক আয়োজন কিংবা ঢাকার বাইরে ও ভেতরে বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর ইতিহাস পাচ্ছেন বিভিন্ন হাসপাতালের বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা কে বলেন, ‘এককথায় বলতে গেলে করোনার বিপদ বাড়ছে। উদ্বেগও বাড়ছে। কিন্তু এর পরও মানুষের মধ্যে সেই অনুপাতে সতর্কতা দেখা যাচ্ছে না। কয়েক দিন ধরেই অব্যাহতভাবে শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি দেখেও মানুষ সাবধান হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় ভিড়ের মধ্যেই শিক্ষিত মানুষকেও মাস্ক ছাড়া দেখা যাচ্ছে, আবার কেউ মাস্ক পরলেও তা ঠিকভাবে পরছে না, কেউ হয়তো গলায় বা কানে ঝুলিয়ে রাখছে। এত করে বোঝানোর পরও মানুষ যে কেন নিজের বিপদ বুঝতে পারছে না, সেটাই আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।’
নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘সারা দিন মিডিয়ায় মানুষকে সাবধান করা হচ্ছে, মাস্ক পরতে ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলা হচ্ছে। টিকা নিয়েই যেন কেউ নিজেকে নিরাপদ না ভাবেন—সেটা বলা হচ্ছে, কিন্তু সবাই সব কিছু দেখে শুনে বুঝেও সতর্কতা পালন করছে না। যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের ইতিহাস জেনে আমরা অবাক হচ্ছি; অনেকেই টিকা নিয়েই ঘুরতে বেরিয়েছেন আনন্দসহকারে। আর ঘুরে এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন করোনা নিয়ে। আমরা বলছি—টিকা নিতে হবে সবাইকেই। কিন্তু মাস্কও পরতে হবে অপরিহার্যভাবে।’
এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি অনুসারে আমাদের ব্যবস্থাপনা আবার আগের মতো বৃদ্ধিতে নজর দিয়েছি। যে হাসপাতালগুলো বন্ধ করা হয়েছিল, তার মধ্যে কয়েকটি আবার চালু করার জন্য চিঠি দিয়েছি। বিশেষ করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, মিরপুর লালকুঠি হাসপাতাল, মহানগর হাসপাতাল ও হলি ফ্যামিলি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে তাদের ব্যবস্থাপনায় আবারও করোনা চিকিৎসা শুরুর অনুরোধ জানিয়েছি। এ ছাড়া আরো কোথায় কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা-ও দেখছি। হাসপাতালে যে ঘাটতি আছে, সেগুলোও পূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর কে বলেন, ‘অনেকের কাছেই এখন বড় প্রশ্ন—টিকা নেওয়ার পরও কেন তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা টিকা দেওয়ার কারণেই তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কি না! আমরা এমন প্রশ্ন শুনে অনেকটাই বিস্মিত হচ্ছি, কারণ টিকা দেশে আসার আগে থেকেই এবং টিকা দেওয়া শুরুর পর থেকেই বারে বারে প্রচার হচ্ছে যে টিকা দেওয়ার পরও করোনায় যে কেউ আক্রান্ত হতেই পারেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ারও দুই-তিন সপ্তাহ পর ছাড়া এই টিকা পূর্ণাঙ্গ কার্যকর হবে না। তবে প্রথম ডোজ দেওয়ার তিন সপ্তাহ পর থেকে ভালো মাত্রায় অ্যান্টিবটি তৈরি হওয়া শুরু করে।’ তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমাদের হাসপাতালে কিংবা প্রাইভেট চেম্বারেও যারা করোনার উপসর্গ নিয়ে কিংবা পজিটিভ হয়ে চিকিৎসার জন্য আসছে, তাদের ইতিহাস জানতে গেলেই দেখি বড় একটি অংশ টিকা নেওয়ার পরপরই ছুটে গেছেন কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটা বা ঢাকার জনবহুল এলাকাগুলোতে; যেখানে তাঁরা ভিড়ের মধ্যে অবস্থান করলেও সঠিকভাবে সব সময় মাস্ক পরেননি কিংবা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মানেননি, অথবা টিমের কেউ কেউ মাস্ক পরেছে, কেউ কেউ পরেনি। আর যারা এবার আক্রান্ত হচ্ছে তারা প্রায় সবাই এবারই প্রথম আক্রান্ত হয়েছে। কাউকে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে যারা গত বছরও আক্রান্ত হয়েছে বলে আমাদের জানায়।’
ওই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন যারা হাসপাতালে আসছে তাদের উপসর্গগুলো আগের মতোই। জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা রয়েছে। তবে সবারই হয়তো সবগুলো একসঙ্গে নয়, সাধারণত যাদের আগে থেকে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা রয়েছে, তাদের মধ্যে কারো কারো করোনা পজিটিভ হলেও করোনার উপসর্গগুলো নেই। কিন্তু অন্য সমস্যা থাকার কারণে তারা হাসপাতালে যাচ্ছে সতর্কতামূলকভাবে। আবার অনেকেরই অন্য কোনো সমস্যা না থাকলেও করোনার উপসর্গ হিসেবে কমবেশি শ্বাসকষ্ট থাকায় হাসপাতালে এসেছে।
এদিকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর কে বলেন, অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশেও এখন যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই প্রথমবারের মতো করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বা হচ্ছে। বাকি দু-একজন গত বছরও আক্রান্ত হয়েছিল, তবে তাদের অন্যান্য রোগের জটিলতাও রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার হিসাবে দেশে করোনাভাইরাস টেস্ট করিয়েছে ২৫ হাজার ১১১ জন। এর মধ্যে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে দুই হাজার ৮০৯ জন। এর আগে সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট শনাক্ত ছিল দুই হাজার ৬৬৮ জন। মাঝে প্রায় সাত মাসে দৈনিক এই শনাক্তের সংখ্যা প্রতিদিন এর চেয়ে কম ছিল। অন্যদিকে গতকাল সকাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় যে ৩০ জন মারা গেছে, এর আগে সর্বশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যু হয়েছিল ৩০ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত ৩০ জনের মধ্যে ২৭ জনের বয়স ৫১ বছরের ওপরে। এর মধ্যে ২০ জন ষাটোর্ধ্ব। একজন ১১-২০ বছরের, একজন ৩১-৪০ বছরের ও একজন ৪১-৫০ বছরের।
মৃতদের মধ্যে ২৫ জন পুরুষ ও পাঁচজন নারী, যাদের মধ্যে ২৪ জন ঢাকা বিভাগের, চারজন চট্টগ্রাম বিভাগের, একজন করে খুলনা ও সিলেট বিভাগের। অন্যদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছে এক হাজার ৭৫৪ জন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৭ জন। এর মধ্যে মারা গেছে আট হাজার ৭২০ জন ও সুস্থ হয়েছে পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ১৫৯ জন। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার উঠেছে ১১.১৯ শতাংশে।
এদিকে গতকাল সর্বোচ্চ পরীক্ষা হওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, এর আগে কখনোই দেশে করোনা টেস্ট ২৫ হাজার ছাড়ায়নি। তবে গতকাল ওই সংখ্যার ভেতরে বিদেশগামী হিসেবে পরীক্ষা করিয়েছেন ছয় হাজার ১৪৪ জন এবং আরো প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো টেস্ট হয়েছে চলমান মুজিববর্ষ অনুষ্ঠান ঘিরে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরেক প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনার টিকা নিতে নিবন্ধন করেছেন ৬২ লাখ ৮২ হাজার ৮৮৪ জন। এর মধ্যে ৪৯ লাখ ১১ হাজার ৯০২ জন টিকা নিয়েছেন। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৭০ হাজার ৯৩৩ জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *