নতুন এক সকালের প্রার্থনা |

দেখতে দেখতে আরো একটা বাংলা বছর শেষ হয়ে ১৪২৮ বাংলা বছর শুরু হলো। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি এত কঠিন সময় আর কখনো পার করেনি। একই কথা সম্ভবত বিশ্বের অনেক দেশের ক্ষেত্রেও সত্য। ইউরোপব্যাপী সর্বশেষ খারাপ সময় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে গত শতকের ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মন্দা ছিল সেই দেশের সবচেয়ে খারাপ সময়। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ ও ছেচল্লিশের দাঙ্গাও বাঙালির জন্য একটি ভয়াবহ সময় ছিল। এগুলো ছিল মানবসৃষ্ট। আর গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দুনিয়াজুড়ে কভিড-১৯ অতিমারির কারণে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা এককথায় নজিরবিহীন। শেষ হবে কখন তা কেউ জানে না। বৃহস্পতিবার দেখলাম ভারতে পরিস্থিতি এই মুহূর্তে এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে দিল্লির অনেক হাসপাতালে একই বিছানায় দুজন রোগীকে জায়গা দিতে হয়েছে। মৃতদেহ পড়ে আছে হাসপতালের বারান্দায়। ব্রাজিলে প্রতি তিন মিনিটে একজন মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থাও তেমন একটা ভালো কিছু নয়। রোগী হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুল্যান্সের ভেতর ছটফট করতে করতে স্বজনদের সামনে মারা যাচ্ছে। কারণ ভেতরে কোনো বেড খালি নেই। হাসপাতালের ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সেবা দিতে। রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১৬০ জনের বেশি চিকিৎসক কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

এই মহামারি কালে অনেকেই হারিয়েছেন তাঁদের নিকটজন, আর দেশ হারিয়েছে তার অনেক কৃতী সন্তানকে। আমার পিঠাপিঠি ছোট বোনটা মারা গেল অতিমারি শুরুর দিকে, ৩০ মে। আন্ত জেলা সব যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ ছিল বলে তাকে শেষবারের মতো দেখতেও যেতে পারিনি। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? তারপর শুরু হলো দেশের কৃতী সন্তানদের চলে যাওয়ার পালা। একেকজন যাচ্ছেন, দেশের একটি করে বাতি নিভে যাচ্ছে। সর্বশেষ বাংলা বছরের প্রথম দিন আমাদের ছেড়ে গেলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান আর একই দিন মারা গেলেন সংসদ সদস্য, সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নবনির্বাচিত সভাপতি আবদুল মতিন খসরু। এই মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছিল সম্ভবত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে দিয়ে ২৮ এপ্রিল ২০২০ সালে। তারপর একে একে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, শিল্পী মুর্তজা বশীর, সাংবাদিক কামাল লোহানীসহ আরো অনেকে। এঁদের সবার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। সবাই আমাকে স্নেহ করতেন ছোট ভাইয়ের মতো। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সিদ্ধান্ত নিল প্রফেসর রফিকুল ইসলাম, প্রফেসর আনিসুজ্জামান আর প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীকে তাঁদের জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্তিতে সংবর্ধনা দেবে। এই ধরনের অনুষ্ঠান মঞ্জুরি কমিশনে এই প্রথম। অনুষ্ঠানে তিনজনই তাঁদের বক্তৃতায় মঞ্জুরি কমিশনের এমন একটি উদ্যোগের প্রশংসা করলেন। আজ সবই স্মৃতি।

আমাকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করেছে আনিসুজ্জামান স্যারের চলে যাওয়া। ১৯৭৩ সাল থেকে আমি স্যারের সহকর্মী ছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম থেকেই স্যার আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। অনেকটা ছোট ভাইয়ের মতো। তিনি সব সময় আমাকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করতেন। বহুদিন অনুরোধ করেছি তিনি যেন আমাকে অন্য আর দশজনের মতো ‘তুমি’ সম্বোধন করেন। কিন্তু সফল হইনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন তাঁর জীবনের একটি সোনালি অধ্যায় বলে বিবেচনা করি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি বিধিবদ্ধ পর্ষদে নির্বাচিত বা মনোনীত সদস্য ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। উপাচার্য প্যানেলে নির্বাচিত হয়েছেন। আনিসুজ্জামান স্যার যখন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে স্যারের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ হয়েছিল। একজন ছাত্র তো এই প্রতিবাদের অংশ হিসেবে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল। অথচ স্যার যখন অধ্যাপক পদে নির্বাচিত হয়ে যোগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন তিনি শুরুতে যোগ দিতে পারেননি। স্যারের সহধর্মিণী বেগম সিদ্দিকা জামানের সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার বিপুলা পৃথিবী’তে তিনি তা বর্ণনা করেছেন। আনিস স্যারের প্রফেসর ইমেরিটাস হওয়াটাও সহজ ছিল না। অনেক সহকর্মীর কাছে শুনেছি, একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় তাঁর মতাদর্শের বিরোধীরাও তাঁর নিয়োগ সমর্থন করেছিলেন। তা না হলে তাঁর এই পদে নিযুক্তি হতো না। নানা আইনের ফাঁকফোকরের কারণে তিনি বাংলা বিভাগের সভাপতিও হতে পারেননি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর সরাসরি ছাত্রী। বঙ্গবন্ধু নিজেও স্যারকে সম্মান করতেন। দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের। স্যার তখন একটি বৃত্তি নিয়ে গবেষণা করতে বিদেশ যাচ্ছিলেন। কথা দিয়েছিলেন ফিরে এসে এই পদে তিনি যোগ দেবেন। তাঁর আগেই ১৫ই আগস্টের ঘটনা।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন বাঙালির বাতিঘর। তিনি যেদিন চলে গেলেন মনে হচ্ছিল এক অদ্ভুত অন্ধকার দেশটাকে গ্রাস করেছে।

শামসুজ্জামান খান একজন আপাদমস্তক বাঙালির প্রতিকৃতি। বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করার আগে মহাপরিচালক ছিলেন। এর আগে তিনি শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় জাদুঘরেরও মহাপরিচালক ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তাঁর এক কন্যা আমার ছাত্রী ছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মাসখানেক আগে তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ টেলিফোনে আলাপ। বিষয় ছিল বাংলা একাডেমির বইমেলা। শামসুজ্জামান খান আমার অগ্রজতুল্য। সব সময় তাঁকে জামান ভাই বলে ডাকতাম। গত কয়েক বছর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছিল। অনেকেই কেন এই পুরস্কার পাচ্ছেন তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার ছিল না। সেই সমালোচনায় জামান ভাইও অংশগ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি গ্রন্থ সংকলন করতে জামান ভাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই জামান ভাইও চলে গেলেন একেবারে বছরের প্রথম দিন। আমার পরামর্শ নেওয়ার আরো একজন মানুষ কমে গেল।

সাবেক আইনমন্ত্রী, সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু। সবার নজর কেড়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর। সেদিন সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিলের বিল উত্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। এই আইনের বলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুনিদের বিচার থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন এবং তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আবদুল মতিন খসরু সেদিন দীর্ঘ সময় নিয়ে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, কেন এই আইন সভ্যতাবিরোধী এবং কেন তা বাতিলযোগ্য। সংসদে তখন পিনপতন নীরবতা। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত। তাঁর কান্না যেন থামে না। অনেকের মতো আমিও চিন্তা করছিলাম তিনি সংসদে উপস্থিত না থাকলে বোধ হয় ভালো হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা হয়তো সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চেয়েছিলেন। রেডিও-টিভিতে সারা দেশের মানুষ সেদিন আইনমন্ত্রীর সেই বক্তৃতা শুনেছেন। এ দেশের মানুষ আপনাকে আজীবন মনে রাখবে প্রয়াত আবদুল মতিন খসরু।

লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি স্মরণে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে। তখন তাঁকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। বলেছিলেন, কিছুদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। শিল্পী মুর্তজা বশীর সম্পর্কে এর আগে পৃথকভাবে লিখেছি। আলী যাকের একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, নাট্যশিল্পী, লেখক। মঞ্চনাটককে তিনি অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এমন বহুমুখী প্রতিভার মানুষ কম দেখেছি। বিশ্বাস করতে পারি না, তিনি আমাদের মাঝে নেই। রশীদ হায়দার আমার অগ্রজপ্রতিম সহকর্মী নাট্যকার জিয়া হায়দারের ছোট ভাই। একসময় আমরা একই পাড়ার বাসিন্দা ছিলাম। রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে একটি ওষুধের দোকানে বসে আড্ডা দিতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই সুযোগ আর কখনো আসবে না। পশ্চিমবঙ্গের লেখক দেবেশ রায় আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’-এর সঙ্গে। এই অতিমারি তাঁকে নিয়ে গেল। আমাদের কালের উত্তম কুমারের পাশাপাশি আর এক নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি যখন ডায়ালগ বলতেন কখনো মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন। আবৃত্তি করতেন অসাধারণ। তবে সিনেমার চেয়ে মঞ্চনাটক তাঁর পছন্দ ছিল বেশি। একবার পাশাপাশি সিটে বসে তাঁর সঙ্গে কলকাতা থেকে ঢাকা এসেছিলাম। প্রায় ৩০ মিনিটের ফ্লাইট। তবে কথা হলো অনেক। বললেন, সময় পেলে তিনি একবার সূর্য সেন আর প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দেখতে চট্টগ্রাম যেতে চান। তাঁকে খোলা আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলাম। তিনি আর কখনো চট্টগ্রাম যাবেন না।

১৪২৭ ও ১৪২৮ বঙ্গাব্দের শুরুটা দেশটাকে তো বটেই; পশ্চিমবঙ্গকেও অনেকাংশে উজাড় করে দিল। স্থানাভাবে সবার কথা লেখা সম্ভব নয় বলে দুঃখিত। এবারের মতো নতুন বছরের প্রথম দিন বা একুশের বইমেলা জীবনে কখনো দেখিনি। কবে এই তিমির রাত্রি শেষ হবে তা জানি না। কারণ এ দেশের এক শ্রেণির মানুষ মনে হয় চায় না দেশ আবার তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসুক। সার্বিক অবস্থায় তাদের সংখ্যা বেশি মনে হচ্ছে। তার পরও প্রার্থনা, আবার ফেব্রুয়ারি মাসে একুশের বইমেলা হোক, আবার রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিক ছায়ানট। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন বছরের প্রথম দিন মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হোক। আবার দেশে কয়েক কোটি টাকার ফুল বিক্রি হোক। এই যাত্রায় বেঁচে থাকলে সামনের বছর আবার একটা নতুন সকাল হবে সেই প্রার্থনাই করছি। প্রয়াত সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *