করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় |

বিশ্বজুড়ে টানা আট সপ্তাহ ধরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে। করোনা সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৮২ হাজার ৫২৭ জনের প্রাণ নিয়েছে এই মহামারি। এ ছাড়া করোনা শনাক্ত হয়েছে তিন কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৪৪৬ জনের।

যুক্তরাষ্ট্রের পর করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ভারত। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। ভারতে করোনাভাইরাসের এক দিনে সংক্রমণের নতুন বিশ্বরেকর্ড হয়েছে। দেশটিতে গত বুধবার এক দিনে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে তিন লাখ ১৪ হাজার ৮৩৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ১০৪ জনের। মহারাষ্ট্র, দিল্লি ও কর্ণাটকে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। বেঙ্গালুরুতেও এক দিনে করোনায় সর্বোচ্চ সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। বিহার, রাজস্থান, তামিলনাড়ু ও মণিপুরে নতুন করে বিধি-নিষেধ ঘোষণা করা হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ডে নতুন করে এক হাজার ৩৯০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ভারত ছাড়াও রাশিয়া, পোল্যান্ড ও ইরানের সংক্রমণ বাড়ছে। তবে সংক্রমণে ভারতের পরেই রয়েছে ব্রাজিল। দেশটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ ৭৮ হাজার ৫৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ইউরোপের দেশগুলো করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে টিকাদান কর্মসূচির ওপর জোর দিচ্ছে। এ কারণে বায়োএনটেক ও ফাইজারের বাড়তি ১০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করছে। ফ্রান্সে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের মধ্যেও হাসপাতালগুলোর নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র ভরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধেকের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ করোনার এক ডোজ টিকা পেয়েছে। কানাডায় করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কয়েক বিলিয়ন ডলার পুনর্বাসন পদক্ষেপ নিচ্ছে। জাপানেও করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। দেশটির কয়েকটি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।

সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ মার্চ বেশ কিছু বিধি-নিষেধসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে সরকার। এর মধ্যে ঘরের বাইরে গেলে মাস্কের ব্যবহার অন্যতম। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক আকার নেওয়ায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রথমে ৫ এপ্রিল থেকে সাত দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ জারি করেছিল। পরে তা আরো দুদিন বাড়ানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আরো কঠোর বিধি-নিষেধ দিয়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় বাড়িয়ে এখন ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করা হয়।

করোনা প্রতিরোধে লকডাউন বাস্তবায়নে বিশেষ বিবেচ্য বিষয় :

১. স্বাস্থ্যবিধি মানানো : যেসব দেশ স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মেনে চলেছে তারা ভালো আছে। অনেক দেশ লকডাউন না দিয়ে শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যেমন—দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকং। বিগত ১৫ মাসের করোনা পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা হলো স্বাস্থ্যবিধি হচ্ছে করোনা প্রতিরোধের প্রধান রক্ষাকবচ। কঠোর না হয়ে কোনো দেশ এটি মানাতে পারেনি। প্রয়োজনে আমাদেরও কঠোর হতে হবে ।

২. নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রণোদনা : লকডাউনে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা কর্মহীন-উপার্জনহীন হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে তাদের ঘরে আটকে রাখা কঠিন। এ বিষয়ে সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে দ্রুত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের প্রায় ৩৫ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেবেন। এ ছাড়া সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ কৃষক পরিবার পাবে পাঁঁচ হাজার করে। এ জন্য সরকারের ৯৩০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় এক কোটি ২৫ লাখ পরিবারকে খাদ্য সহযোগিতা দেবে।

৩. করোনা রোগ নির্ণয় পরীক্ষা : করোনা পরিস্থিতির সঠিক চিত্র জানার জন্য পরীক্ষার হার সর্বোচ্চ রাখতে হবে। সরকার পরীক্ষার জন্য ২২৩টি কেন্দ্র স্থাপন করেছে। করোনা সন্দেহ হলে নিকটস্থ পরীক্ষা কেন্দ্রে অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে, নইলে পরিবারের যে কেউ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারে। করোনা রোগী আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন হচ্ছে প্রতিরোধের অন্যতম উপায় ।

৪. করোনা রোগীর চিকিৎসাব্যবস্থা করা : করোনা সংক্রমণ বেশি হারে বেড়ে গেলে উন্নত দেশও সামাল দিতে পারছে না। তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ রাখাই আমাদের প্রধান কর্তব্য। দেশের চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতে সক্ষম। ব্যবস্থা থাকলে চিকিৎসা কোনো সমস্যা নয়। এরই মধ্যে সরকার ২৫০ আইসিইউসহ এক হাজার শয্যার একটি হাসপাতাল চালু করেছে। আমাদের যেন হাসপাতালে না যেতে হয় সে জন্য আমাদের শুরু থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

৫. টিকা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা : টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা জল্পনা-কল্পনা আছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, টিকাগ্রহণকারী মানুষের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন এবং মৃত্যুঝুঁকি অনেক কম। তাই আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকের টিকা নেওয়া প্রয়োজন। করোনাভাইরাসের টিকাগ্রহণকারীরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কম বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, টিকা নেওয়ার পর আক্রান্তদের মধ্যে ৮২.৫ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে হয়নি। টিকা নেওয়ার পর আক্রান্ত হওয়া ১৭.৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাদের মধ্যে কোনো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা যায়নি।

৬. সব মহলের সহযোগিতা ও সমন্বয় সৃষ্টি : সত্যিকার অর্থে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে সরকারের পাশাপাশি দেশের সব মহলকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বিষয়টি একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়ে দাঁড়িয়েছে—আমাকে আমি রক্ষা না করলে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। তাই সরকার, সব রাজনৈতিক দল, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক শক্তি, গণমাধ্যম সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে লকডাউন বাস্তবায়ন করলে অবশ্যই করোনা নিয়ন্ত্রণ হবে। জরুরি কাজ এবং চলাচল তো থাকবেই।

অন্যদিকে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) রোগের তীব্রতা আরো বেড়েছে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। সংস্থাটি বলছে, কভিড-১৯ রোগীরা খুব দ্রুত মারা যাচ্ছে।

হাসপাতালে করোনায় মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ দিনের মধ্যে মারা গেছে। আর ৫ থেকে ১০ দিনের ভেতরে মারা গেছে ১৬ শতাংশ।

দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইউকে ভেরিয়েন্ট সংক্রমণে শতকরা ৭০ ভাগ বেশি শক্তিশালী এবং অনেক বেশি প্রাণঘাতী।

সব বিবেচনায় আরো করণীয়—

১. লকডাউন ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করতে হবে, প্রয়োজনে জোনভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে। ২. চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য নজরদারি রাখতে হবে, নইলে বেশিসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। ৩. করোনা প্রতিরোধের সব কর্মকাণ্ডে তীক্ষ নজরদারি রাখতে হবে, যাতে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা না হতে পারে। গত বছর অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান দেশবাসী দেখেছে। ৪. বিভ্রান্তমূলক প্রচার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ তৎপরতায় বাংলাদেশ প্রথম ধাপেই এক কোটি দুই লাখ ডোজ পেয়েছে। সরকারকে দ্রুত টিকা সংগ্রহ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস-গ্যাভির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক উদ্যোগ কভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি (কোভ্যাক্স)। কোভ্যাক্স থেকে আগে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশকে টিকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ হিসাবে বাংলাদেশের ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা। এর মধ্যে আগামী মে মাসের মধ্যে এক কোটি ৯ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু এখনো কোনো টিকা পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় কোভ্যাক্স থেকে আবারও চিঠি দিয়ে টিকার চাহিদার কথা জানতে চাওয়া হলো। ভারতের সেরাম কিংবা কোভ্যাক্সের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বিকল্প উৎস থেকেও টিকা পেতে তৎপরতা শুরু করেছে সরকার। এ লক্ষ্যে তিন দেশের পাঁঁচটি টিকার বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে। সেরামের টিকার অনিশ্চয়তা সৃষ্টির পর বিকল্প উৎস থেকে টিকা পেতে তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। তিন দেশের পাঁচটি টিকাকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখে সেগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি পেতে চেষ্টা করছে সরকার। এই পাঁঁচটি টিকার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসন ও মডার্না, চীনের সিনোফার্ম ও ক্যানসিনো এবং রাশিয়ার স্পুিনক ভি রয়েছে।

পাশাপাশি সেরামের টিকা পাওয়ার তৎপরতা অব্যাহত আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশকে টিকা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। টিকা পাওয়ার বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপার ।

আমরা প্রিয়জনদের লাশের ভার আর বহন করতে পারছি না—সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে তৎপর হলে নিশ্চয়ই আমরা এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *