জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি করে সকল তামাকজাত পণ্যকে জনগণের ক্রয়সীমানার বাইরে নিয়ে যাওয়া দরকার। এমন মত দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের। তারা আজ বেসরকারী মানবাধিকার ও গবেষণা সংস্থা ভয়েস আয়োজিত এক অনলাইন মতবিনিময় সভায় এই দাবি জানান। আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে ‘জনস্বাস্থ্য সুরায় তামাকের কর বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক ওয়েবিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। সভাপতিত্ব করেন, পিকেএসেফের চেয়ারপয়ার্সন এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। ওয়েবিনারে বক্তব্য রাখেন, সংসদ সদস্য শিরীন আখতার, অসীম কুমার উকিল, এরোমা দত্ত, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাক ফ্রি কিডস এর লিড পলিসি এডভাইজার মোস্তাফিজুর রহমান, ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন্ করেন ভয়েসের প্রকল্প সমন্বয়ক জায়েদ সিদ্দিকী।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান আলোচনার সভার আয়োজকদের সাধুবাদ জানান । তিনি কর বৃদ্ধির সপক্ষে নিজের অবস্থান জোরাল বলে ঘোষনা দেন এবং তামাকের বিরুদ্ধে লড়াইকে সবাইকে সংঘবদ্ধ থাকতে আহবান জানান। তিনি বলেন, “তামাক যে ক্ষতিকর পণ্য তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। যেহেতু আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষনা দিয়েছেন যে ২০৪০ এর মধ্যে বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত করবেন তখন এটাই সুবর্ণ সুযোগ তামাকের ওপর কর বৃদ্ধি করার”। এ নিয়ে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার আশ্বাস দেন পরিকল্পনা মন্ত্রী।
ড. কাজী খলীকুজ্জামান বলেন, এক শতাংশ স্বাস্থ্য সারচার্জের পাশাপাশি এক শতাংশ সারচার্জ যদি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নেয়া যায় তাহলে খুব ভালো হবে। “প্রধানমন্ত্রী তামাকমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন কিন্তু সব কাজ উনি একা করতে পারবেন না। যারা কাজ করতে পারবেন তাদের এ বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে” বলে তিনি মতামত দেন।
সংসদ সদস্য ব্যারিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “আমাদের দেশে বহুস্তরবিশিষ্ট কর ব্যবস্থা বিরাজমান যেটা পৃথিবীর কোন দেশে নেই এবং তামাক কর থেকে সুফল না পাওয়ার পিছনে এটা একটা প্রধান কারন। কোনো দেশে কখনো তামাকের ওপর কর আরোপের কারণে রাজস্ব কমেনি। তাই আমাদের দেশেও তামাকের ওপর সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করতে হবে। এটা করলে রাজস্ব কমবে না বরং এটা পরীক্ষিত যে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে এবং এই প্রাপ্ত অতিরিক্ত রাজস্ব থেকে তামাক সেবী, তামাক চাষি, বিড়ি শ্রমিক এবং তামাক ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে”।
শিরিন আখতার এমপি বলেন, “যা ক্ষতিকর সেটাকে ক্ষতিকর বিবেচনা করে শক্ত হাতে এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সংসদকে ধূমপান মুক্ত করতে হবে। শুধু সংসদে না স্থানীয় পর্যায়ে, উপজেলা পর্যায়ে, ইউনিয়নের মেম্বারদের এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এই নিয়ে কথা বলতে হবে এবং তামাক বিষয়ে আগামীতে নীতি নি হবে সেই বিষয়ে রোডম্যাপ তৈরী করতে হবে”। এই বাজেটে তামাকের কর বৃদ্ধি পাবে বলে উনি আশা ব্যক্ত করেন।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধে বলা হয় বাংলাদেশে প্রচলিত তামাক কর ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল যেখানে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন মাত্রার কর আরোপ করা হয়েছে। এছাড়াও অতীতে তামাকের ওপর কর আরোপ করে ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করা হলেও মানুষের আয় বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তামাকের দাম বৃদ্ধি না পাওয়ায় পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হয়নি বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় (নমিন্যাল) বেড়েছে ২৫.৪ শতাংশ কিন্তু এ সময়ে বেশিরভাগ সিগারেটের দাম প্রায় অপরিবর্তিত থেকেছে বা সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষ করে নিম্ন স্তরের সিগারেটে কর বৃদ্ধির মাত্রা নগণ্য হওয়ায় তামাক পণ্য থেকে গেছে সহজলভ্য। এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বিড়ি সিগারেটের মত ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার কমানো সম্ভব হয়নি।
বিশ্বে সর্বোচ্চ তামাক ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম দিকে। দেশে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। প্রতিবছর ১ লক্ষ্য ৬১ হাজার মানুষ তামাক জনিত রোগে প্রাণ হারায় এবং অনেকে অকালে পঙ্গু হয়ে যান। কিন্তু সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল প্রভৃতি তামাকজাত পণ্য সহজলভ্য হওয়ায় এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছেনা।
যেহেতু তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য এ সব পণ্যে করারোপের মাধ্যমে বিক্রয়মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা একটি কার্যকরী পদ্ধতি সেহেতু আসন্ন বাজেটকে কেন্দ্র করে তামাকের ওপর কিছু কর প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়-
· নিম্ন স্তরের সিগারেটে ৫৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও বাকীগুলোর ওপর ৬৫ শতাংশ শুল্কের পরিবর্তে সকল স্তরের সিগারেটের ওপর সমভাবে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব
· সব স্তরের সিগারেটের ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক ঘোষিত খুচরা মূল্যের ৬৫ শতাংশ করতে হবে
· এর পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখতে হবে
· ফিল্টার-বিহীন বিড়ির ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূকরক শুল্ক প্রস্তাব ঘোষিত খুচরা মূল্যের ৪৫ শতাংশ করতে হবে
· এবং গুল ও জর্দার ওপরে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক খুচরা মূল্যের ৬৬ শতাংশ করতে হবে।
আলোচনায় বলা হয় যদি এ কর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে ১১ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহী হবে এবং ৮ লক্ষাধিক তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে ৩ লক্ষ ৯০ হাজার বর্তমান ধূমপায়ী এবং ৪ লাখ তরুণের অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি এই বিপুল জনগোষ্ঠী জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবে।
আলোচনায় সাংবাদিক সেলিম সামাদ, মনজুরুল আহসান বুলবুল, রোড সেফটি প্রোগ্রাম গ্লোবাল হেলথ এডভোকেসী ইঙ্কিউবেটরের কান্ট্রি কোর্ডিনেটর ড শরিফুল আলম, প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম যুবায়ের, এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক এবং আস্থার কো কনভেনর নাদিরা কিরন উপস্থিত ছিলেন।
Source: kalerkantho