পুণ্য শুক্রবার বা গুড ফ্রাইডে |

খ্রিস্ট ধর্মের রহস্যাবৃত বিশ্বাসতত্ত্ব হলো যিশুর যাতনাভোগ ও মৃত্যুর পুণ্যফলে সমগ্র জগৎ লাভ করেছে পরিত্রাণ। প্রতিবছর খ্রিস্টবিশ্বাসীরা এই বিশ্বাসের রহস্য উদযাপন করার জন্য ৪০ দিনের সাধনা করে থাকে। ৪০ দিনের এই কালকে বলা হয় প্রায়শ্চিত্তকাল বা তপস্যাকাল। এই বছর এই কাল শুরু হয়েছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে, গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা ও উপাসনা তথা খ্রিস্টযজ্ঞ উৎসর্গ করে এবং তপস্যা ও প্রায়শ্চিত্তের চিহ্নস্বরূপ কপালে ছাই বা ভস্ম মেখে। এই ৪০ দিন ধরে আমরা খ্রিস্টবিশ্বাসীরা মানুষের পাপের কারণে যিশু যে যন্ত্রণাভোগ করেছেন ও ক্রুশমৃত্যুবরণ করেছেন সেই ঐতিহাসিক সত্য ধ্যান করেছি; পবিত্র বাইবেল পাঠ করেছি। এবং সর্বোপরি আমরা আমাদের পাপের জন্য অনুতাপ করেছি, উপবাস বা রোজা রেখেছি : প্রার্থনা, ভিক্ষাদান ও উপবাস—এই তিন ধরনের অনুশীলন করে এই উপবাস বা প্রায়শ্চিত্তকালকে সার্থক ও ফলপ্রসূ করে তোলার সাধনা করেছি। পাপের স্বভাব ত্যাগ করার জন্য সাধনা করেছি; পুনর্মিলিত হয়েছি ঈশ্বরের সঙ্গে ও একে অন্যের সঙ্গে। ৪০ দিনের এই তপস্যা শেষে আমরা উপনীত হয়েছি আজকের এই পুণ্য শুক্রবারে যিশুর ক্রুশমৃত্যু ধ্যান করতে ও উদযাপন করতে। এরপরই পুনরুত্থান রবিবার বা ইস্টার সানডে মহোৎসব।

আজ ২ এপ্রিল শুক্রবার। আজ যিশুর মৃত্যু দিবস। আজ উপবাস বা রোজা থাকা আবশ্যিক। আজ অন্যান্য ধারায় তপস্যা করার দিন। আজ বিশেষভাবে যিশুর মৃত্যু ধ্যান করে, পবিত্র ক্রুশের দিকে ধ্যানপূর্ণ দৃষ্টি রেখে এই সত্য স্বীকার করার দিন যে আমার পাপের জন্য, শুধু আমার একার পাপের-মুক্তির জন্য নয়, গোটা মানবজাতির তথা সারা জগতের পরিত্রাণের জন্য যিশু ক্রুশে মৃত্যুবরণ করেছেন। অতএব পুণ্য শুক্রবারের কেন্দ্রীয় আহ্বান, পাপের পথ পরিত্যাগ করে পুণ্যের পথে ফিরে আসার আহ্বান।

পুণ্য শুক্রবার ও প্রভুর কষ্টভোগী সেবক প্রসঙ্গ পুণ্য শুক্রবারে পবিত্র বাইবেল থেকে শুনি প্রভুর যন্ত্রণাভোগী সেবকের কথা : ‘তিনি ছিলেন উপেক্ষিত, সকলের পরিত্যক্ত, এক শোকার্ত মানুষ, দুঃখের সঙ্গে যার দীর্ঘ পরিচয়! তিনি আমাদেরই দুঃখের বোঝা বহন করেছেন, …তিনি আমাদের অন্যায় অধর্মের জন্য বিদ্ধ হয়েছেন; আমাদের অপরাধের জন্যই দলিত হয়েছেন; আমরা যেন তাঁর ক্ষতগুলির গুণেই সুস্থ হয়ে উঠি’ (নবী ইসাইয়ার পুস্তক ৫২ অধ্যায় ১৩ পদ থেকে ৫৩ অধ্যায় ১২ পদ পর্যন্ত)।

পুরনো নিয়ম  (Old Testament) বর্ণিত এই দুঃখভোগী সেবকই হলেন নতুন নিয়মে  (New Testament) বর্ণিত যন্ত্রণাভোগী প্রভু যিশু। যিনি আমাদের অপরাধের জন্য ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন; আমরা যেন সুস্থ হয়ে উঠি, আমরা যেন পাপমুক্ত হই; পরিত্রাণ লাভ করি। তাঁর ক্রুশমৃত্যু আমাদের সবার জন্য, সমগ্র জগতের জন্য স্বর্গের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই পুণ্য শুক্রবার বা গুড ফ্রাইডে উপাসনায় সাধু যোহনের লেখা মঙ্গলসমাচারে বর্ণিত যিশুর যাতনাভোগ ও মৃত্যুর কাহিনি পাঠ করা হয় (যোহন ১৮:১-১৯:৪২)। আমরা এই ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ধ্যান করি।

আমরা অবাক হই এই ভেবে যে যিশুখ্রিস্ট ঘৃণা-অপমান, চাবুক-চাপড়, মাথায় কাঁটার মুকুট, ক্রুশে জীবনদানের মধ্য দিয়েই হলেন তিনি গৌরবে মহান, এনে দিলেন মানবপরিত্রাণ। এই অসহনীয় যাতনাভোগ ও মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করেই বিজয়  (Triumph) অর্জন করলেন। তাঁর এই মৃত্যু পরিত্রাণদায়ী মৃত্যু, তাঁর এই ক্রুশ পরিত্রাণদায়ী ক্রুশ; এই নিগূঢ় সত্যে বিশ্বাসী হয়েই খ্রিস্টবিশ্বাসী ক্রুশকে এত অধিক শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। প্রতিটি গির্জায় ক্রুশ স্থাপন করা হয়।

পুণ্য শুক্রবারে পবিত্র বাইবেল থেকে নির্ধারিত পাঠ করা হয়। পরিচালক যাজক (ফাদার) ধর্মোপদেশ দেন। এরপর ক্রুশের আরাধনা করা হয়; ক্রুশের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করা হয়; ক্রুশকে ভক্তি-চুম্বন করা হয়; এভাবেই ক্রুশের আশীর্বাদ অর্জন করে খ্রিস্টবিশ্বাসী ভক্ত।

এই দিন ঈশ্বরের কাছে এবং পরস্পরের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দিন; একে অন্যকে ক্ষমা করে পুনর্মিলিত হওয়ার দিন। এই দিনে পাপের জন্য অনুতাপের চিহ্নস্বরূপ প্রাপ্তবয়স্ক সবাই উপোস করে, রোজা রাখে। গরিব-অসহায়কে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহায়তা দান করে। গির্জায় উপাসনার এক পর্যায়ে ক্রুশ চুম্বন করে পাশে রাখা পাত্রে যথেষ্ট অর্থ দান করে কৃতজ্ঞতা, ভক্তি-ভালোবাসা ও প্রায়শ্চিত্তের চিহ্নস্বরূপ। ভক্তদের এই দান দরিদ্র-অসহায়দের জন্যই ব্যবহার করা হয়।  যিশুর এই ক্রুশমৃত্যু বিভক্ত মানুষকে এক করে তুলেছে। অতএব পুণ্য শুক্রবারের আহ্বান : সব বিভক্তি শেষ করে দিয়ে শান্তি ও মিলন স্থাপন করা। একক বা দলগত হিসেবে আক্রমণ, ভীতি প্রদর্শন, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অস্ত্র চালানো, এমনকি হত্যা করার মধ্যে বিজয় নেই। পক্ষান্তরে এই পুণ্য শুক্রবারে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-কৃষ্টি-সংস্কৃতি সবাই এক হয়ে শান্তি-সম্প্রীতি ও মিলনের সমাজ ও দেশ গড়ার আহ্বান এই পুণ্য শুক্রবারে। এবং আরো অনেকভাবেই আমরা পুণ্য শুক্রবার বা গুড ফ্রাইডের মহিমায় আলোকিত হতে পারি এবং যিশুর মুক্তিদায়ী রক্তে নিজেদের ধৌত করতে পারি।

গুড ফ্রাইডে ও ইস্টার সানডে একসঙ্গে যুক্ত। ৪ এপ্রিল এ বছর যিশুর পুনরুত্থান দিবস। ইস্টার সানডে। খ্রিস্টীয় পরিভাষায় এই রবিবারকে বলা হয় পুনরুত্থান রবিবার; কেননা খ্রিস্টবিশ্বাস অনুসারে যিশু কবরে থাকেননি; মৃত্যুর পর তৃতীয় দিবসে তিনি পুনরুত্থান করেছেন। এটি একটি পবিত্র শাস্ত্রভিত্তিক ঐতিহাসিক সত্য। মৃত্যুকে জয় করে, পাপের অপশক্তিকে নিষ্পেষিত করে খ্রিস্ট যিশু পুনরুত্থান করেছেন; মানুষের জন্য নতুন জীবন, মুক্তিপ্রাপ্ত জীবন অর্জন করেছেন। পুনরুত্থান ছাড়া যিশুর মৃত্যু বৃথা। যিশুর পুনরুত্থান তাঁর মৃত্যুকে পূর্ণ অর্থ ও সার্থকতা এনে দিয়েছে। তাই আগামী ৪ এপ্রিল রবিবারের মহোৎসব যিশুর পুনরুত্থানের মহোৎসব; পাস্কা (যার অর্থ নতুন জীবনে পদার্পণ) মহোৎসব; নতুন জীবনের মহোৎসব। এ জন্যই ইস্টার সানডে বা পুনরুত্থান রবিবারে খ্রিস্টবিশ্বাসীরা আনন্দে ও উৎসবে মেতে ওঠে।

আজ পুণ্য শুক্রবার। আসুন, এই দিনের আহ্বানে সাড়া দিই এবং ইস্টার মহোৎসব পালন করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করি।

লেখক : ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেক্রেটারি, বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপদের খ্রিস্টীয় ঐক্য ও  আন্তর্ধর্মীয় সংলাপ কমিশন


Source: Kalerkantho.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *