এই অন্ধকার থেকে বেরোতে হবে |

দেশের অগ্রগতি-উন্নয়ন নিয়ে যতই আনন্দে থাকি না কেন, স্বস্তি কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক কিছুরই আধুনিকায়ন হচ্ছে। ডিজিটাল অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির অঙ্গনে গুণগত তেমন পরিবর্তন আসছে না। বরং অ্যানালগ ধারা মরচে পড়ে আরো অকার্যকর হচ্ছে। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবেলা করার মতো মানসিক দৃঢ়তা কোনো পক্ষের রাজনীতিকদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার অন্ধকার পথ খুঁজে বেড়ায় সব পক্ষ। এসব আচরণ গণতন্ত্রের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্রের পথ মসৃণ হয় না। বাংলাদেশে এখন কার্যত তেমন বিরোধী দল নেই। আপাতদৃষ্টিতে শক্তিশালী আওয়ামী লীগ ও এর সরকারেরই উচিত ছিল শক্তিশালী বিরোধী দল বেড়ে উঠতে দেওয়া। তাহলে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা নানা দল-মতের উত্থান ঘটে না। সরকারপক্ষকে পরিপূর্ণ মনোযোগে একটি প্রতিপক্ষের দিকে নজর রাখলেই চলে।

১৮৮৫ সালে ইংরেজ সরকার নানা দেশীয় রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার আগেই নিজ উদ্যোগে ইংরেজ সিভেলিয়ান অ্যালান অক্সেভিয়ান হিউমকে দিয়ে ভারতীয় নেতাদের নিয়ে অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠন করিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ ভারতীয়দের যা কিছু ক্ষোভ-বক্তব্য সব কংগ্রেসের মধ্য দিয়েই আসুক।

kalerkanthoকিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের দেশে আওয়ামী লীগের বাইরে তেমনভাবে বিরোধী দল দাঁড়াতে পারল না। বিএনপির সার্বিক অবস্থান মূল্যায়ন করলে মনে হবে যেন পারিবারিক ঐতিহ্যবিহীন হঠাৎ বড়লোক হওয়া মানুষের উত্কট বিলাসিতা। নিজের ওজন তারা মাপতে পারে না। তাই অতি বাড় বাড়ার কারণে ঝড়ে ভেঙে পড়ে সহজেই। এভাবে বিএনপি রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে ফোর্স কমান্ডারের সম্মান বিএনপি নেতারা যথেষ্ট গৌরবের মনে করতে পারেননি। তাই হঠাৎ বড়লোকদের মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে বিএনপি নেতানেত্রীদের মধ্যে। ইতিহাসকে অস্বীকার করে জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বানায়। জাতির শোকাবহ দিনটিকে আড়াল করার জন্য ১৫ আগস্ট নিজ নেত্রীর বিশেষ জন্মদিন ঘোষণা দেয়। ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি আর মাগুরা নির্বাচনের মডেলে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে। পরবর্তী সময়ে সুবিধাবাদীরা এসব অপপ্রয়াসকে অনুসরণ করে মাত্র। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার দোসর জামায়াতে ইসলামীকে পক্ষপুটে নিয়ে বিএনপি যেন আত্তীকরণ করে ফেলে। বঙ্গবন্ধু হত্যার খলনায়ক জিয়াউর রহমান কি না আমরা বলতে পারব না। তবে স্বঘোষিত হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করা ও এদের পুরস্কৃত করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার আমলে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের স্বাধীন দেশের মন্ত্রী বানিয়ে অন্যায়ের ষোলোকলা পূর্ণ করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় গ্রেনেড হামলাসহ জঙ্গি সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। ক্ষমতায় থেকে বিএনপি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। এসব এত প্রকাশ্য যে সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে আওয়ামী লীগ নানা পথে বিএনপিকে মোকাবেলা করেছে। বিএনপি রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগে। এর বদলে জামায়াতকে নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির পেছনে হেঁটেছে বিএনপি। এসব করে নিজের পায়েই কুঠার চালিয়েছে। তবু আত্মোপলব্ধি হয়নি। সাধারণ মানুষকে বিরক্ত করা, ক্ষুব্ধ করা অপশক্তি হেফাজতের তাণ্ডবকে সমর্থন করছে। এভাবে বারবার বিএনপি জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

আজ বিএনপি যখন আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেছে তাতে অনেক কিছুতে যে বস্তুনিষ্ঠতা নেই তেমন নয়, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এখানে অভিযোগকারী বিএনপি। সব অন্যায়ের পথে যে দলের নেতারা হেঁটে এসেছেন। তাই বিএনপিকে মানুষ গ্রহণ করবে কোন ভরসায়! কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলে বা কর্মী-সমর্থক হলে অনেকেই বিবেকের শাসনে চলতে পারেন না। দলের হাজার অন্যায় বিনা প্রশ্নে মেনে নেন। তেমন দলীয় নেতা-সমর্থকরাই বিএনপির কর্মসূচিতে যুক্ত থাকেন। এই বাস্তবতাকে জনগণের পাশে থাকা বলে না। সব রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে একই মন্তব্য করা যেতে পারে।

আওয়ামী লীগও কি সব সময় জনগণকে পাশে নিয়ে রাজনীতি করে? জনগণের মতামতকে ধারণ করে? অনেকেই লক্ষ করবেন যদি দলীয় সম্মেলন হয়, যেমন—ছাত্রলীগের সম্মেলন, আওয়ামী লীগের সম্মেলন তখন নেতানেত্রীরা চারপাশে হাজার হাজার দলীয় কর্মী-সমর্থক দেখে মনে করেন এঁরাই বোধ হয় এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ। তখন চারপাশের সবাইকে এ দেশের সব মানুষের মুখপাত্র মনে করে বেফাঁস মন্তব্য করতে থাকেন। হেফাজতে ইসলাম নামে সংগঠনটির নেতারা অন্তরে রাজনৈতিক অভিলাষ রেখে ধর্মের অপব্যাখ্যা ঠোঁটে ঝুলিয়ে উসকে দিচ্ছেন মাদরাসার সরল-নিরীহ ছাত্রদের। এই নেতারাও হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকের জমায়েত দেখে ভাবেন, এঁরাই বোধ হয় এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ। সুতরাং ধরাকে সরা জ্ঞান করে বক্তব্য দিতে থাকেন। শান্তিবাদী ধর্ম ইসলামী আদর্শের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট না রেখে তালবে এলেমদের হাতে তুলে দেন লাঠিসোঁটা আর বিনাশী আগুন। তা নিয়ে এরা চড়াও হয় সাধারণ মানুষ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রেলগাড়ির যাত্রীদের ওপর। তাদের রক্তাক্ত করে। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় সরকারি সম্পদ। বেসরকারি বাড়িঘর, সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফিস। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবিরের করা তাণ্ডবের সঙ্গে এদের আচরণের কোনো ফারাক নেই। তাহলে রাজনৈতিক অভিলাষের কথা গোপন রাখছেন কেন? এসবকে কি মুনাফেকি বলে!

পাঠক, হেফাজতের উত্থানের পর থেকে এরা কিন্তু ইসলামের সৌন্দর্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরার কোনো কর্মসূচি নেয়নি। শুধু নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে ইসলামের নামে দুর্বল ব্যাখ্যা দিয়ে অনুসারী ও সাধারণ মুসলমানকে উত্তেজিত করে অনৈসলামিক কাজ করে যাচ্ছে। হেফাজত নেতারা ইসলামী লেবাস গায়ে জড়িয়ে আগেও অনেক নৈরাজ্য করেছেন, যা ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশ করে না। মোটেও তুলনীয় নয়, তবু বলব এ দেশে যাঁরা ইসলাম প্রচার করেছেন, মুসলিম সমাজ বিস্তারে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা ছিলেন সুফি। ইসলামে সৌন্দর্য ধারণ করে তাঁরা এগোতেন। মানবতাবাদী ছিলেন তাঁরা। আল্লাহপ্রেম ও মানবপ্রেম ছিল তাঁদের ধর্ম প্রচারের মূল শক্তি। কিন্তু এ সময়ের লেবাসি হেফাজতি নেতারা নিজেদের স্বার্থে তৈরি করছেন নৈরাজ্য। পরিকল্পনার অংশ বলে হঠাৎ উপর্যুপরি ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। ভাস্কর্যবিরোধী ইস্যু নিয়ে তাণ্ডব, ছদ্মবেশী চেহারা নিয়ে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের বাড়িঘর ও ধর্ম মন্দিরে ভাঙচুর, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমন নিয়ে তাণ্ডব—এর একটিরও সঙ্গে কি ইসলামী আদর্শের মিল রয়েছে?

সব শিয়ালের এক রা-এর মতো তেলে-জলে মিশ খেয়ে গেল। মৌলবাদীদের মোদিবিরোধী তাণ্ডবে যোগ দিল কয়েকটি বাম সংগঠন। যদিও হেফাজতিদের মতো আদর্শচ্যুত বাম দলগুলোর তেমন প্রভাব নেই সাধারণ মানুষের মধ্যে, তবু মৌলবাদীদের সঙ্গে একাট্টা হওয়াটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। আর এসবের মধ্যে পেছন থেকে হাওয়া দিচ্ছে রাজনীতিতে পরাস্ত বিএনপি। শুরু থেকেই হেফাজতি তাণ্ডবে সায় ছিল বিএনপির। তারা পুলিশের গুলিতে নিহত হেফাজত কর্মীদের মৃত্যু নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন। এই জায়গাটি যৌক্তিক ছিল। কিন্তু একটি দায়িত্বশীল দল হিসেবে একবারও হেফাজত নেতাদের কাছে প্রশ্ন তোলেননি সাধারণ ছাত্রদের জঙ্গি কায়দায় কেন মাঠে নামালেন? সরকারি ও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি কেন ধ্বংস করলেন? বিএনপি মহাসচিব হুট করে হেফাজতের ডাকা হরতালকে সমর্থন জানালেন। অর্থাৎ সব তাণ্ডবের সঙ্গে নিজেদের সমর্থন যুক্ত করলেন। এরপর ঘরে-বাইরে সমালোচিত হলো বিএনপি। তাই আবার বিএনপি মহাসচিব বিবৃতি দিলেন তাঁরা হেফাজতের আন্দোলনকে সমর্থন করেন না। এভাবেই পেণ্ডুলামের মতো দুলছে বিএনপির রাজনীতি। বোধগম্য কারণেই জামায়াতে ইসলামী দলও সমর্থন জানিয়েছিল হেফাজতের হরতালকে। ইসলামী শিক্ষা যা-ই থাক না কেন, কিভাবে পিকেটিং করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা যায় তা মাদরাসাছাত্রদের দিয়ে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন হেফাজত নেতারা।

তবে দুশ্চিন্তার কথা এই যে মৌলবাদী হেফাজত-জামায়াতের সঙ্গে অভিন্ন প্রতিবাদে যোগ দিয়েছে কোনো কোনো বামপন্থী দলের ছাত্ররা। আমার এক বামপন্থী প্রাক্তন ছাত্র মজা করে বললেন, ‘ওরা হচ্ছে ইসলামী মৌলবাদীদের বামপন্থী টিম।’ আর সবার পেছনে হাওয়া দেওয়ার জন্য বিএনপি তো আছেই।

তবে আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের সাফল্যকে ম্লান করতে, দেশের এগিয়ে চলার যাত্রাকে দুর্বল করার জন্য এটি এক বড় ধরনের চক্রান্ত। এমন অবস্থায় দেশপ্রেমিক মানুষ মন্দের ভালো মনে করে হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে দাঁড়াবে। তবে এই সমর্থন নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। কঠিন দলতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে সবার আপন হতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়ে অনেকটা সমালোচনার মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনৈতিকভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে। অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে যাচ্ছে। এই আনন্দে বিভোর থাকলে চলবে না। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি বন্ধে সরকারের আন্তরিকতা সাধারণ মানুষ দেখতে চায়। আমরা মনে করি এই সংকটময় অবস্থায় সাধারণ দেশপ্রেমিক মানুষকে আস্থায় আনা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এই সময়ে এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হলে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। গণশক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই।

এই শক্তিকে যূথবদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার যদি বাস্তবের উঠোনে পা রাখে, তবে অপশক্তি অপসারিত হবে। সম্ভব হবে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা।

 

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বব্যািলয়

[email protected]


Source: Kalerkantho.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *