আঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব |

বিশ্বের অন্যান্য অংশের আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক সংগঠনগুলোর, যেমন—ইইসি, আসিয়ান, জিসিসি ইত্যাদির সফলতা, বিশেষ করে ওই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার তখনকার নেতারা অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) নামের প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ পাঁচ বছর নানা পর্যায়ের আলাপ-আলোচনার পর ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সার্কের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংস্থাটি আত্মপ্রকাশ করে। সার্ককে ঘিরে শুধু এ অঞ্চলের নেতারাই নয়, প্রতিটি দেশের জনগণ দেখেছিলেন অনেক স্বপ্ন, তাঁদের মন ভরে ছিল কতই না আশা। আমরা জানি, নানা কারণেই চলতে গিয়েও সংস্থাটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এগোতে পারেনি, যেমনটি আশা করা গিয়েছিল। এ অবস্থায় অনেক সদস্য দেশই নিজেদের উন্নয়নের ধারাকে আরো গতিশীল ও প্রাসঙ্গিক করার জন্য যে যার মতো এশিয়ার এ অঞ্চলের মধ্যেই সহযোগিতার অন্যান্য সমীকরণের পথ খুঁজতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই সার্কের কতিপয় সদস্যের বিমসটেক, বিবিআইএন, বিসিআইএম-ইসি প্রভৃতি প্রয়াসের সঙ্গে সংযুক্তি। যাকে অনেকেই উপ-আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক এসব প্ল্যাটফর্ম মূলত জোটগতভাবে এ এলাকার প্রতিটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এ প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন সার্ক সদস্যদের নিয়ে, তেমনি সার্ক ও আসিয়ানের সদস্যের বা পার্শ্ববর্তী দেশের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। এখানে লক্ষণীয় যে ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এমন একটি স্থানে, যার সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রায় সব দেশের স্থল যোগাযোগ সম্ভব। এ ছাড়া জলপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগসূত্রের কেন্দ্র। অর্থাৎ বাংলাদেশের মাধ্যমে আশপাশের সব দেশ ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা সবচেয়ে সহজভাবে হতে পারে। সর্বোপরি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের গুরুত্ব কম নয়। সংগত কারণেই বাংলাদেশ এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তেমনি তার নিজস্ব উন্নয়নেও এ অবস্থান অত্যন্ত ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মার্চ মাসের ১৭ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে এসেছিলেন মালদ্বীপের ও নেপালের রাষ্ট্রপতি এবং শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী। যোগদানকারী অতিথিরা সবাই সার্ক সদস্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান। সার্ক সদস্যের বাইরে অন্য কোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান আমাদের এ আয়োজনে উপস্থিত না থাকতে পারলেও তাঁদের শুভেচ্ছা বার্তা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়নি। যা-ই হোক, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির এই মহাদুর্যোগের সময় তাঁদের বাংলাদেশ সফর আমাদের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বের গভীরতা এবং দৃঢ় বন্ধনকেই প্রতিফলিত করেছে।

আগত অতিথিরা এবং শুভেচ্ছা বার্তা প্রেরণকারী রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা, প্রত্যেকেই যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভ কামনা করেছেন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে স্মরণ করেছেন, একইভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশকে উন্নয়নের বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি, নিরলস প্রচেষ্টা, কার্যকর দিকনির্দেশনা এবং গতিশীল নেতৃত্বের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বিশ্বনেতারা আস্থা প্রকাশ করে বলেছেন যে তাঁর নেতৃত্ব শুধু বাংলাদেশেরই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। আমরা জানি, তিনি এরই মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে বাংলাদেশকে উন্নয়নের একটি অনুসরণযোগ্য আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান করা ছাড়াও প্রতিটি দেশের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে ফলপ্রসূ আলাপ-আলোচনা, কথাবার্তা হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিটি দেশের কয়েকটি করে সমঝোতা স্মারক ও দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিষয়ে সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে অদূরভবিষ্যতে আরো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনাও রয়েছে। তাঁদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনায় যেমন বিদ্যমান সমস্যার একটি চিত্র পাওয়া যায়, তেমনি আগামী দিনে সাহায্য-সহযোগিতার নতুন দিকের কথাও জানা যায়। পাঁচটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়াও আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে আরো বিস্তারিত, সুদৃঢ় এবং উন্নয়নমুখী করার লক্ষ্যে এসব আলাপ-আলোচনা অবশ্যই কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে সব কিছুর বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হতে হবে ‘সকলেই আমরা সকলের তরে’ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এবং সবার সমষ্টিগত কল্যাণ ও উন্নয়নে।

এ সময়ে আলোচিত ও স্বাক্ষরিত দলিলের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে বাংলাদেশ প্রতিটি দেশের সঙ্গে পৃথকভাবে অর্থনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সম্পর্ক গভীর ও দৃঢ় করার লক্ষ্য ছাড়াও প্রতিবেশী এসব দেশের সঙ্গে সমষ্টিগতভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টিকেও প্রাধান্য দিয়েছে। দেশের সঙ্গে দেশের, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের বিষয়টি সামগ্রিক উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ক্ষেত্রে তৃতীয় দেশের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিও উত্থাপিত বা সংরক্ষিত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যেমন ভারতের সঙ্গে সমঝোতার সময় ভুটান বা নেপালের সুবিধা ও স্বার্থের কথা বলেছে, তেমনি ভুটানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে ভারতের সংশ্লিষ্টতার বা প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ না করে পারেনি। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের সব দেশের সম্পর্ককে একসূত্রে গ্রথিত করার কথা আন্তরিকভাবেই ভেবেছে, কোনো ফাঁক রাখেনি। বাংলাদেশ অন্তত মনে করাতে সক্ষম হয়েছে যে সমষ্টিগত প্রগতি ও উন্নয়নের বিকল্প কিছুই নেই, যা এ অঞ্চলকে একটি শান্তিপূর্ণ এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করবে।

আমরা জানি, আমাদের এসব আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মে ভারত ছাড়াও চীন অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে জড়িত। ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ছাড়াও আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে যে সম্পর্ক রয়েছে, তা খুবই চমৎকার এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। সার্কের একজন সদস্য এসবের মধ্যে না থাকায় সমস্যা অনেকটা কম থাকলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক একটু দোটানায় যে ফেলেই দিয়েছে। তবে ভারত ও চীন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করলে আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মের ভিত্তিটা নড়বড়ে হওয়া থেকে রক্ষা পেত। রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। তবু আঞ্চলিক কাঠামোতে এ বিষয়টি সুরাহা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বিধায় সে সুযোগ নিতে কি কোনো দোষ আছে? চীন ও ভারত ইচ্ছা করলেই একমাত্র তা সম্ভব। এ বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ একটাই, যাতে আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর পথচলা স্থবির না হয়ে যায়।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতে বাংলাদেশে এসে সার্কের এই পাঁচ নেতা শুধু বাংলাদেশ ও তার জনগণের সঙ্গে তাঁদের দেশ ও জনগণের বন্ধুত্বকেই শক্তিশালী করে যাননি, বরং আগামী দিনে এ অঞ্চলকে একটি উন্নত ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করতে সব জনগণের মধ্যে সংহতি ও অদম্য অনুপ্রেরণার বীজ বপন করে গেছেন। এ বীজ থেকে যথাযথ অঙ্কুরোদ্গম হওয়ার জন্য আমাদের সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। আর এ জন্য যে দূরদৃষ্টি, ত্যাগ এবং কর্মপরিকল্পনার প্রয়োজন হবে সে দায়িত্ব নেবেন আমাদের নেতারা। তবে এ কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে এ সব কিছু যাদের উদ্দেশে, সেই জনগণের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। এক দেশের জনগণের অন্য দেশে তাঁদের বন্ধুদের কষ্ট বা সমস্যার কথাও ভাবতে হবে, সেসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে, সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। নিজেদের একটু অসুবিধা হলেও বন্ধুর মুখে হাসি ফোটাতে হবে। মনে রাখতে হবে, সবাই মিলে ভালো থাকলেই সবচেয়ে ভালো থাকা যায়। আর এই দর্শনই হচ্ছে আঞ্চলিক সংস্থাগুলো গঠনের মূল উদ্দেশ্য।

সার্কের পাঁচজন নেতার আগমন এবং অনুষ্ঠিত আলাপ-আলোচনা বাংলাদেশকে এক নতুন আলোকবর্তিকার সন্ধান দিয়েছে। আর সেটি হলো আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে আরো গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিকে উপস্থাপনের আহ্বান। তবে বাংলাদেশকে এসব আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় কার্যকর নেতৃত্ব দিতে গেলে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমেই আসে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি করেছেন। বিশ্বনেতাদের কাছে তিনি একজন নির্ভরযোগ্য, দূরদর্শী এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দক্ষ মেধাসম্পন্ন জনবল যাঁরা নেতৃত্বকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করবেন। আর সর্বশেষটি হচ্ছে কূটনৈতিক দক্ষতা। এ দুটি পর্যায়ে বাংলাদেশকে আরো পরিশ্রম করতে হবে। নেতৃত্বকে শক্তি ও সার্বিক কূটকৌশল জোগান দিতে আন্তর্জাতিক মানের একটি অভিজ্ঞ জনবল এবং কূটনীতিবিদদের টিম তৈরি করতে হবে। এ তিনটির কোনো একটি পর্যায় দুর্বল হলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে। মূলত এ বিষয়গুলোর সক্ষমতার ওপরই নির্ভর করবে আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নেতৃত্বের সম্ভাবনা।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *