দুর্গম ঈদ যাত্রা |

তখন সকাল পৌনে ১০টা। রাজধানীর মিরপুরের রিহান রেন্ট-এ-কারের সামনে মানুষের জটলা। ঈদে সবাই বাড়ি যাবে, তাই গাড়ি ভাড়ার জন্য এমন ভিড়। তবে সবার মুখ মলিন। সবাইকে হতাশ করে রিহান রেন্ট-এ-কারের মালিক দিলশাদ আহমেদ সাফ জানিয়ে দিলেন, ঈদের আগের দিন পর্যন্ত ভাড়া দেওয়ার মতো কোনো গাড়ি তাঁর কাছে নেই। পাশের আরেকটি রেন্ট-এ-কারের অফিসে কান পাততেই শোনা গেল, কেউ রাতে যেতে চাইলে গাড়ি দেওয়া যাবে। একজন রাতে যেতে রাজিও হলেন। দিলেন অগ্রিম টাকা। সাহাবুদ্দিন নামের ওই ভদ্রলোক যাবেন কুমিল্লার হোমনায়। ১০ যাত্রী বহনে সক্ষম এমন একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করলেন ১৩ হাজার টাকায়। সাহাবুদ্দিন বললেন, দূরপাল্লার বাস চালু থাকলে পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে যেতে পারতাম দুই হাজার টাকায়, এখন লাগছে ১৩ হাজার টাকা।

করোনা মহামারির এই সময়ে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকলেও থেমে নেই ঈদ যাত্রা। তবে রাজধানী শহরের সীমানা পর্যন্ত চলাচল করছে সিটি বাস, প্রতিটি জেলার সীমানা পর্যন্ত ওই জেলার বাসও চলছে। অন্যবারের ঈদের চেয়ে এবার আগেভাগেই ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। আগেভাগে কেন ঈদ যাত্রা—এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, এবার বাড়ি যেতে যানবাহন পাল্টাতে হবে বারবার। বাসের বদলে বিভিন্ন ধরনের পরিবহনে যেতে হতে পারে। এ কারণে সময় ও টাকা বেশি খরচ হবে। পথের ক্লান্তি ও ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে একাধিক যাত্রী বলেন, ঝুঁকি তো থাকবেই, তার পরও ঈদ যাত্রা আনন্দের।

এদিকে অর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষ ঢাকা ছাড়ছে প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে, অন্যরা যাচ্ছে জেলায় জেলায় বাস পাল্টিয়ে। আবার নিম্ন আয়ের মানুষ ঢাকা ছাড়ার পরই ব্যবহার করছে নছিমন, করিমনসহ স্থানীয় পরিবহন। সব মিলিয়ে দূরপাল্লার বাস-ট্রেন বন্ধ রেখেও মানুষের গ্রামে ফেরা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। নানা কায়দায় ছুটছে মানুষ। গেল বার ঈদের পর ব্যাপক হারে বেড়েছিল করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু। এ কারণে এবারের ঈদ নিয়ে সংক্রমণভীতি থেকেই যাচ্ছে।

দেশে করোনার সংক্রমণ এখন অনেকটাই নিম্নমুখী। শনাক্তের হার ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। সরকারের চলমান বিধি-নিষেধের কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে। ঈদ যাত্রা রোধে কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে চলমান বিধি-নিষেধ আগামী ১৬ মে পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। এমনকি ঈদের ছুটি তিন দিন নির্ধারণ করে দিয়ে সব চাকরিজীবীকে কর্ম এলাকায় থাকার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এর পরও গ্রাম অভিমুখে মানুষের ঈদ যাত্রায় রাশ যদি টানা না যায়, তাহলে করোনা সংক্রমণ ফের মাথাচাড়া দিতে পারে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরাও।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদ ঘিরে করোনা সংক্রমণের শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে। তাই সরকারকে ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে।

পরিবার নিয়ে ঈদ করতে যশোর যাচ্ছেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নাজমুল ইসলাম। গাবতলী টার্মিনালসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা সড়কে সাভারগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সঙ্গে স্ত্রী ও শিশুকন্যা। কে তিনি বলেন, খবর নিয়েছি সাভারের বাস যায় মানিকগঞ্জ সীমানা পর্যন্ত, সেখান থেকে মানিকগঞ্জের বাসে পাটুরিয়া, ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে রাজবাড়ীর বাসে ফরিদপুরের সীমানা সাইনবোর্ড পর্যন্ত, ফরিদপুর থেকে কামারখালী ব্রিজ, এরপর মাগুরার বাসে সীমাখালী গিয়ে যশোরের বাসে চলে যাব বেনাপোল। গাবতলীতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী একাধিক যাত্রী যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ যাওয়ার এমন ছকই কষছে।

পাটুরিয়া ঘাট থেকে ঢাকায় ফেরা যাত্রী রফিকুল আবেদীনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ। তিনি নিজ কর্মস্থল কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় ফিরেছেন, এখন যাবেন সোনারগাঁ। যাত্রাপথের ভোগান্তি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, কুষ্টিয়া থেকে তিনি রাজবাড়ী পর্যন্ত এসেছেন স্থানীয় পরিবহন নছিমনে। ১০ জন লোক বসা যায় এমন একটি নছিমন তাঁরা জনপ্রতি ৪০০ টাকা ভাড়ায় ২১ জন এসেছেন। এরপর বাস পাল্টাতে পাল্টাতে ঢাকায় পৌঁছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকলেও সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার। একই সঙ্গে রাজধানীর বাইরে বীরদর্পে চলছে স্থানীয়ভাবে তৈরি ইঞ্জিনচালিত যান। সরকারের অনুমোদনহীন এসব যান যাত্রী বহন করছে স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে ঘুষের চুক্তিতে। স্থানীয়ভাবে ওই সব পরিবহন নছিমন, করিমন, আলম সাধুসহ নানা নামে পরিচিত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেতে হলে পদ্মা নদী পার হতে হয়। যেসব যাত্রী পাটুরিয়া হয়ে যাচ্ছে, তারা পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে ফেরিতে। মাওয়াঘাট হয়ে যাত্রীরা কেউ স্পিডবোটে, আবার কেউ ইঞ্জিনচালিত নৌযানে পদ্মা পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিটাগাং রোডের সাইনবোর্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সারি করে দাঁড়িয়ে আছে মাইক্রোবাস। চলছে হাঁকডাক। কুমিল্লা-ফেনী-ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কে যাবেন কোথায়! যার কাছ থেকে যেভাবে পারছে, পকেট কাটা হচ্ছে। যাত্রীও মিলছে। গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে একের পর এক মাইক্রোবাস।

এদিকে ঢাকা মহানগর ও জেলাভিত্তিক বাস চালুর প্রথম দিনেই ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যবিধি। রেন্ট-এ-কারের মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারে গাদাগাদি করে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। স্থানীয় অনুমোদনহীন পরিবহনগুলোতেও একই অবস্থা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী থেকে সাভারগামী ইতিহাস পরিবহনে দেখা যায়, আমিনবাজার পার হওয়ার পরই প্রতি আসনে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে, আরো কয়েকটি পরিবহনে দেখা যায় দাঁড়ানো যাত্রীও নেওয়া হচ্ছে।


Source: kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *